জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক এবং মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা

জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন বা জোসেফ স্তালিন বা যোসেফ স্ট্যালিন বা জোসেফ স্ট্যালিন (ইংরেজি: Joseph Vissarionovich Stalin; ১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ৫ মার্চ ১৯৫৩) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মানে এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দীর্ঘতম সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ তথা বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ইউসিফ ভিসারিওনোভিচ সোসো, স্তালিন নামটি তিনি ১৯১০ সালে ‘লৌহমানব’ অর্থে ধারণ করেন।[১]

তিনি ১৮৭৯ সালেরর ১৮ ডিসেম্বর জর্জিয়ার অন্তর্গত গৌরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন পেশায়  জুতা নির্মাণ শিল্পের মালিক। তাঁর পিতা মাতা কেউই রুশ ভাষা জানতেন না। স্তালিন গোরী চার্চ স্কুলে পড়াশুনাকালে (১৮৮৮ – ৯৪) পড়াশুনার মাধ্যম হিসেবে রুশ ভাষা শেখেন। একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে স্তালিন বিদ্যালয়ে পুরো বৃত্তি ভোগ করেন। পুরোহিত্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পড়াশুনাকালে স্তালিন তৎকালীন নিষিদ্ধ সাহিত্য তথা মার্কসের ‘পুঁজি’ অধ্যায়নের মাধ্যমে রুশ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার গোড়াঁ সমর্থকে পরিণত হন। এই অপরাধে ১৮৯৯ সালে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হতে তাঁকে।

স্তালিন তিবলিসে রেল কর্মচারীদের মাঝে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন প্রচারক হিসেবে তাঁর পেশা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে এবং পরবর্তী বছর তিনি প্যারিস গমন করেন। ১৯০২-১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্ট্যালিন কারাবাস যাপন করেন, সাতবার নির্বাসিত হন এবং ছয়বার পালিয়ে বেড়ান। সরকার কেবল একবার তাঁকে ১৯১৩-১৭ সাল অব্দি লম্বা সময় নির্বাসনে রাখতে সক্ষম হয়।

জার শাসনামলের শেষভাগে (১৯০৫-১৭) স্তালিন ছিলেন ভি আই লেনিনের রাজনৈতিক অনুসারী মাত্র। তিনি সব সময়েই কমিউনিষ্ট পার্টির বলশেভিক অংশের সমর্থক ছিলেন। দলের প্রতি তাঁর অবদান ছিল বাস্তবমুখী। ১৯০৭ সালে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজনে তিবলিসিসিতে এক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় জড়িত হন তিনি। একই বছর তিনি লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনেও উপস্থিত ছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি বলশেভিক পার্টির সংখ্যালঘু জাতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলে লেনিন তাকে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে তুলে নিয়ে আসেন। লেনিনের অনুরোধক্রমে ১৯১৩ সালে তিনি ভিয়েনায় অবস্থানকালে ‘মার্কসিজম এন্ড দ্য ন্যাশনালিটি কোশ্চেন’ গ্রন্থটি রচনা করেন। প্রন্থটি প্রকাশিত হবার আগেই স্তালিনকে সাইবেরিয়া নির্বাসনে যেতে হয়।

১৯১৭ সালে মার্চ বিপ্লবের পর স্তালিন পেট্রোগ্রাডে ফিরে আসেন এবং প্রাভদা পত্রিকার সম্পাদনা কাজ হাতে নেন। অক্টোবর বিপ্লবের পর তিনি পেট্রোগ্রাডে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং লেনিন সরকারের সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সংক্রান্ত কমিশনার নিযুক্ত হন। জাতীয়তাবাদ বিষয়ের একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি হিসেবে লেনিন তাঁকে উক্ত বিষয়ে প্রধান কমিশনারের দায়িত্ব দেন।

বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধের সময় স্তালিন অন্যান্য বিপ্লবীদের নিয়ে লেনিনকে একান্ত সহযোগিতা প্রদান করেন। স্তালিন কমান্ডার হিসেবে ইয়ুদেনিং -এর শ্বেতবাহিনীর হাত থেকে পেট্রোগ্রাডকে রক্ষা এবং জেনারেল ভেনিকিনের হাত থেকে জারিৎসিনকে উদ্ধার করেন। দলের অভ্যন্তরে এসময় স্তালিন তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে নিজস্ব অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন এবং প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদনে দক্ষ হয়ে উঠেন। তিনি ১৯১৯-২৩ সাল অব্দি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯২২ সালে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় স্তালিন দলকে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি সাংগঠনিক ভিত্তিতে পরিণত করেন। এ সময় কোন কোন ক্ষেত্রে অল্প গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে লেনিনের সাথে তাঁর মতপার্থক্য ঘটে।

১৯২৪ সালে লেনিনের মুত্যুর পর স্তালিন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এতে ত্রতস্কির সাথে স্তালিনের দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। তাঁকে অপসারণের লক্ষ্যে স্তালিন নিকোলাই বুখারিনের সাথে সমঝোতায় পৌঁছান এবং লেনিনের অনেক বক্তব্যকে সুকৌশলে ব্যাখ্যা ও প্রচারণার মাধ্যমে তাঁর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেন। এসময় ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’ ‘লেনিনবাদের সমস্যা’ প্রভৃতি পুস্তকাদিও তিনি রচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন।

১৯২৮ সাল থেকে স্তালিন লেনিনবাদের নীতি অনুসারে ‘এক দেশ ভিত্তিক সমাজতন্ত্র’ নীতিমালা গ্রহণ করেন। এ সময় ইউরোপীয় সুবিধাবাদী ধারার বিপ্লবের পরিবর্তে শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এক মহান হারকিউলিসীয় কর্মকাণ্ডের উদ্যোগী হন তিনি। স্তালিন চালিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই কর্মসূচী ছিল ত্রতস্কি প্রচলিত ‘স্থায়ী বিপ্লব‘ নীতির পরিপন্থী। তাঁর এই একটি দেশে এককভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকালে কৃষি উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলে স্তালিন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন এবং সার্বিয়া অঞ্চলে কৃষি কার্যক্রম স্বয়ং তদারকি করেন। ১৯২৯ সালের শেষভাগে কৃষিতে তিনি ‘যৌথ খামার ব্যবস্থা চালু করলে লক্ষ লক্ষ কৃষক স্থানান্তরিত হয় এবং হাজার হাজার কৃষক মহান কৃষি বিপ্লবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩০ এর দশকে স্তালিন শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচারণায় নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে সফল হন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চাৎপদ রিপাবলিকসমূহ শিল্পের শক্তি হিসেবে বিকশিত হয়।

১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের স্তালিন তাঁর শাসনের পক্ষে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারণা ও  বৈপ্লবিক কাজকর্ম এগিয়ে নেন। রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ এবং ভুল চিন্তাধারার উচ্ছেদ ইত্যাদির ফলে বহু পরিবারে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন শুরু হয়। স্তালিনের এই সময় আমলাতন্ত্রের ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীরা স্তালিনের কয়েকজন সঙ্গীদের অনেককেই রাষ্ট্র বিরোধী আখ্যায়িত করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। স্তালিন সেসব ষড়যন্ত্রের অনেকগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম হন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাল দুনিয়া সৃষ্টির মহান কর্মে যুক্ত হন স্তালিন। বিশ্বকে রক্ষার মহান আয়োজন প্রক্রিয়ায় স্তালিন ১৮৪১ সালের ৭মে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হলে স্তালিন স্বয়ং নাৎসী জার্মানীর অগ্রাভিযানের মুখে যুদ্ধ পরিচলনা করেন। দেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে মহান মানবিক তাগ স্বীকারের মাধ্যমে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে তিনি জার্মান বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হন। স্তালিন ১৯৪৩ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত মিত্র শক্তির সভায় যোগদান করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অ-সমাজতন্ত্রী মিত্রদের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ।

কমরিড স্ট্যালিন, ভোরোসিলোভ এবং শ্যাচাদেনকো তারতিসিনের কাছে পরিখায়।

স্তালিন ১৯৪৩ সালে কমিন্টার্ন বা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ভেঙ্গে দেন। ১৯৪৫ সালে ইয়াল্টা এবং পোস্টডাম সভায় যোগদানের মাধ্যমে স্ট্যালিন পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাব বিস্তারের স্বীকৃতি আদায় করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনী কর্তৃক মুক্ত হওয়া দেশসমূহে সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রসার ঘটান। তা সত্ত্বেও, পঞ্চাশের দশকে স্নায়ু যুদ্ধের সুচনার ফলে পাশ্চাত্যের অনুসৃত বৈরী নীতিমালার বিপরীতে তাঁর করণীয় অনেক কিছুই অবশিষ্ট থেকে যায়। সুদীর্ঘ ৩০ বছর একটানা শাসন অব্যাহত রাখার পর ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ স্তালিনের আকস্মিক মৃত্যু মস্কোতে বিশ্ব একজন মহান নেতাকে হারায়।

স্তালিনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরীরা তাঁকে ‘ব্যক্তি পুঁজা’ সৃষ্টির অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পর স্তালিনের অধিকাংশ কার্যক্রম বিংশতম দলীয় কংগ্রেসে বাতিল ঘোষিত হয়। ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত পার্টির ২২তম কংগ্রেসে তাঁকে বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত এবং ক্রেমলিনের পার্শ্ববর্তী রেড ক্সোয়ার থেকে তাঁর মমিকৃত মৃতদেহ অপসারণ করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরীরা তাঁর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে চাইলেও স্তালিনের সুদীর্ঘ শাসনামলে তাঁর অর্জিত সাফল্যকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রদান থেকে শুরু করে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দেশরক্ষা প্রভৃতি ঘটনা অসামান্য সাফল্যেরই খতিয়ান। অনেকের ধারণা, স্ট্যালিনের উত্তরসূরীরা তাঁরই নীতি আদর্শে অটল থাকলে সোভেয়েত ইউনিয়ন তথা রুশ সমাজতন্ত্রের পতনকে হয়ত বা প্রতিহত করা যেত।[২]

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ২১ মে ২০১৯, “জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রনায়ক এবং মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/joseph-stalin/
২. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ১৬৯-১৭১।

রচনাকাল: ২১ মে ২০১৯, নেত্রকোনা বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!