জন মিলটন বা জন মিল্টন (ইংরেজি: John Milton, ৯ ডিসেম্বর ১৬০৮ – ৮ নভেম্বর ১৬৭৪) ছিলেন একজন ইংরেজ কবি এবং বুদ্ধিজীবী, যিনি ইংল্যান্ডের কাউন্সিল অফ স্টেটের অধীনে এবং পরে অলিভার ক্রমওয়েলের অধীনে একজন সরকারী কর্মচারী। সংস্কৃতি ও শিক্ষা চর্চার এক উপযোগী পরিমণ্ডলে বিকশিত হয়েছিল জন মিলটনের ইংরেজি সাহিত্য প্রতিভা। তিনি ধর্মীয় উৎসাহ এবং রাজনৈতিক উত্থানের সময়ে লিখেছিলেন, এবং তাঁর মহাকাব্যিক কবিতা প্যারাডাইস লস্ট (১৬৬৭) (Paradise Lost) এর জন্য সবচেয়ে তিনি বেশি পরিচিত। প্যারাডাইস লস্ট অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখিত, এবং সর্বকালের রচিত সাহিত্যের অন্যতম মহত রচনা হিসাবে বিবেচিত। তাঁর অন্য একটি মহাকাব্য হচ্ছে ‘প্যারাডাইস রিগেইনড’ (Paradise Regained)।
তাঁর অনুশীলনের বিষয়গুলি ছিলো লাতিন, গ্রীক ও হিব্রু ভাষাসমূহ, ধ্রুপদী অলংকারবিদ্যা (Classical Rhetoric) প্রভৃতি। কেমব্রিজে অধ্যয়নকালীনই তিনি অধিকাংশ লাতিন কবিতা, ‘অন দা ডেথ অব এ ফেয়ার ইনফ্যান্ট, (On the Death of a Fair Infant) ও ‘অ্যাট এ ভেকেশান একসারসাইজ’, ( At a Vacation Exercise) রচনা করেছিলেন। যদিও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ কবেছিল ‘অন দি মর্নিং অব ক্রাইসটস নেটিভিটি (On the Morning of Christ’s Nativity) ও ‘অন শেকসপীয়ার’ (On Shakespeare) কবিতা দুটি।[১]
জন্ম ও শৈশব
লণ্ডনের চীপসাইড পল্লীর ব্রেডস্ট্রীটে, ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই নভেম্বর পিতৃগৃহে জন মিলটন জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতা ছিলেন অক্সফোর্ডশায়ারের এক সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন একজন বিদ্বান ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ; ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চা ও সংগীতের ক্ষেত্রে ছিলো তার বিশেষ অনুরাগ। মিলটনের ওপর এই মানুষটির উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিল্যে। সংস্কারপন্থীদের (ইংরেজি: Reformer) পক্ষাবলম্বন করায় মিলটনের বার তাঁর পিতৃসম্পত্তি ও আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হন এবং লণ্ডন শহরে পেশাদার মুসাবিদাকারী (ইংরেজি: Scrivener) হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়াও তার আরও কিছু ব্যবসা ছিল। এই বুদ্ধিচর্চা তথা পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সর্বস্বতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আবহাওয়াতেই মিলটনের জন্ম। পিতার তিন সন্তানের মধ্যে বড়টি কন্যা, পরের দুটি পুত্র। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন জন মিল্টন। কনিষ্ঠ ভাই ক্রিস্টোফার তার চেয়ে সাত বছরের ছোট।
পিতার কাছে মিলটন নানাভাবে ঋণী ছিলেন। এই ঋণের সকৃতজ্ঞ স্বীকার পাওয়া যায় তাঁর কোনো কোনো গদ্য-রচনায়। তার স্বাধীন মনোভাব, সঙ্গীতানুরাগ, সুশিক্ষা, বিদেশভ্রমণ, জীবনের এক পর্যায়ে নিরুদ্বিগ্ন অবসর—সবই সম্ভব হয়েছিল তাঁর স্বাধীনচেতা, কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, সঙ্গীতজ্ঞ ও গুণগ্রাহী স্নেহপরায়ণ পিতার আনুকূল্যে। মিলটন নিজে রাজতন্ত্রবিরোধী হলেও রাজভক্ত ছোটভাই-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল।[২]
শিক্ষাজীবন
পিতা পুত্রের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁর উপযুক্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। স্বগৃহে মিলটনের প্রথম শিক্ষালাভ জনৈক পাদী টমাস ইয়ংয়ের কাছে। স্কটল্যান্ডের অধিবাসী এই ইয়ং একজন সাহিত্যরসিক ব্যক্তি যার উৎসাহ ও প্রেরণায় পড়াশুনার প্রতি মিলটনের গভীর অনুরাগ জন্মে। তার যখন বারো বছর বয়স সেই সময়েই তিনি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করতেন।
১৬২৩-এ সেন্ট পলস স্কুলে তার আনুষ্ঠানিক বিদ্যাভাস শুরু হয় এবং ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভর্তি হন কেমব্রিজের ক্রাইসটস কলেজে। লণ্ডনের সেন্ট পল স্কুলে মিল্টন অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে লাতিন গ্রিক ও হিব্রুভাষা শিক্ষা করেন। এছাড়াও সম্ভবত গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে, তিনি আধুনিক ভাষাগুলিও আয়ত্ত করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের ধারায় মিলটনের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের যে খ্যাতি, তার গোড়াপত্তন অল্পবয়সেই হয়েছিল। নিজেই বলেছেন, ওই বয়সে মাঝরাত্রির আগে তিনি শয্যাগ্রহণ করেন নি। পাঠের প্রতি তার এই অত্যন্ত অনুরাগ তাঁর সারাজীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, এবং তাঁর অন্ধত্বের একটি কারণ দুর্বল দৃষ্টিশক্তির উপর বহু বৎসরের অতিরিক্ত চাপ। তাঁর স্কুল জীবনের বন্ধুদের মধ্যে একজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—চার্লস দিওদাতি (Charles Diodati), পিতা ইতালীয়, মা ইংরেজ। এই লণ্ডনবাসী ইতালীয় ভদ্রলোক ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। বন্ধু দিওদাতির উদ্দেশে রচিত মিল্টনের দুটি লাতিন এলেজী ছাত্রবয়সের রচনা। তাঁর মৃত্যুতে মিল্টন লেখেন একটি শোকগাথা, এটিও লাতিন ভাষায়।
স্কুলের পাঠ শেষ হলে, ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে মিলটন ক্রাইসট কলেজের ছাত্র হিসেবে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। পরবর্তী সাত বৎসর তাঁর কেম্ব্রিজ পর্ব। টিউটরের সঙ্গে সম্পর্কহানির কারণে তাঁকে একবার এক টার্মের জন্য বহিষ্কৃত (rusticated) হতে হয়। তবে টার্মশেষে তার প্রত্যাবর্তন, ও যথাসময়ে তার বি.এ. (১৬২৯) ও এম. এ. (১৬৩২) ডিগ্রি লাভ থেকে ধারণা হয় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অন্যায়ের অভিযোগ ছিল না। সেকালে কেম্ব্রিজে পড়াশুনার কোনো বাধাবাধি নিয়ম ছিল না। প্রচলিত পাঠক্রমে মিল্টনের মনে সাড়া দেয় নি, বরং বিরূপতারই জন্ম দিয়েছিল, যার ফলে কেম্ব্রিজে থাকতেই তিনি শিক্ষার বিষয় ও পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে থাকেন। এবং তার এই ভাবনার লিখিত রূপ পাওয়া যায় তার “শিক্ষা প্রসঙ্গে” [On Education, 1644] নামক প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধ ও প্রায় একই সময়ে লেখা অ্যারিওপ্যাজিটিকা, গ্রিক ও লাতিন ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুরাগী, রেনেসাঁস মানবতাবাদে বিশ্বাসী তরুণ মিল্টনের মানস গঠনের বিশ্বস্ত দলিল।
কেম্ব্রিজের বৎসরগুলিতে মিল্টন তার মাথাভর্তি সোনালী চুল, নীল চোখ, সুন্দর সুগঠিত দেহ, তার নিষ্কলুষ জীবনযাত্রা, চারপাশের আণ্ডার-গ্রাজুয়েটসুলভ হৈচৈ স্থলতা থেকে সযত্ন দূরত্বরক্ষা—এসব কারণে ক্রাইটের মহিলা লেডী অব ক্রাইস্ট খেতাব অর্জন করেছিলেন। বলা বাহুল্য এই খেতাবের মধ্যে মৃদু পরিহাসের সঙ্গে সমপরিমাণেই মিশ্রিত ছিল এক ধরনের সমীহবোধ। কেম্ব্রিজের সাত বৎসর মিল্টন ব্যাপকভাবে স্বাধীন পড়াশুনা করেছিলেন। এই সময়ের রচনা গুটিকয়েক কবিতা, লাতিন এলেজি, যীশুর জন্মপ্রভাতে (On the Morning of Christ’s Nativity, 1629) ও “ল্যা অ্যালেগ্রো” (L, Allegro), এবং “ইল পেনসরোসো” ((L’ Allegro), II Pensoroso, 1931) বাংলায় খোশদিল ও চিন্তাশীল, এই দুটি জোড়–কবিতা।
ইতিমধ্যে কবির পিতা লণ্ডনের ব্যস্ত কর্মজীবনের শেষে প্রায়-অবসর জীবন যাপনের উদ্দেশে শহরের বাইরে হর্টন-এ বসবাস শুরু করেন। কেম্ব্রিজের পাট চুকিয়ে মিল্টনও তার পিতার এই নতুন নিবাসে তার সঙ্গে ছয় বৎসর থাকেন (১৬৩২-১৬৩৮)। এই সময়টা তার পরিকম্পিত ভবিষ্যতের, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবিকর্মের জন্য প্রস্তুতির কাল, সাহিত্য ছাড়াও বিচিত্র বিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত। ইল পেনসরোসোর কয়েকটি ছত্রে এক পড়ুয়া ব্যক্তির বর্ণনা স্পষ্টতই তাঁর এ-সময়ের আত্মপ্রতিকৃতি–
অথবা কারও চোখে পড়বে, মাঝরাতে জ্বলছে–
আমার প্রদীপ, এক নির্জন উঁচু মিনারে।
তারা ডুবছে দিগন্তে, আমি তবু জেগে আছি
মহর্ষি হার্মিসের সঙ্গে, অথবা ডেকে আনছি
প্লেটোর আত্মাকে, তিনি প্রকাশ করবেন
কোথায় সে-জগৎ, সেই বিশাল ভূখণ্ড, যেখানে
বাস করে মৃত্যুহীন মনীষা, এই তুচ্ছ মাংসের
ক্ষুদ্র কক্ষ থেকে তার বসতি তুলে নিয়ে –
(II Pensoroso, 85-92)
আগেই বলেছি, পিতার কাছ থেকে মিল্টন পেয়েছিলেন সঙ্গীতের রুচি। হর্টন পর্বে সঙ্গীতজ্ঞ–কম্পোজার হেনরি ল’জ–এর (Henry Lawes) সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা জন্মে। প্রতিবেশী ছিলেন ডাবীর কাউনটেস। ইতিপূর্বে কাউনটেসের সম্মানে রচিত আর্কেডিস (Arcades) নামে একটি নৃত্য-নাটিকায় সুরকার ল’জ-এর সহযোগিতা করেছিলেন মিল্টন। এবার তারই প্রস্তাবে ও আগ্রহে তাঁর একটি নৃত্যনাট্যের জন্য সংলাপ ও গীতি রচনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি লিখলেন “কোমাস” (Comas, 1634)। এই মাস্ক (Mask) টি অভিনীত হয় ঐ বৎসর লাডলোর দুর্গপ্রাসাদে, শ্রপশায়ার যেখানে ওয়েলসের সীমানা ছুঁয়েছে, এক মধ্যযুগীয় সামন্ত পরিবেশে। উপলক্ষ: লেডী ডার্বীর সৎপুত্র ও জামাতা আর্ল অব ব্রিজওয়াটারের লর্ড প্রেসিডেন্ট অব ওয়েলস হিসেবে নতুন দায়িত্ব গ্রহণ ও তার সরকারি বাসভবনে, লাডলো দুর্গে, গৃহপ্রবেশ।
মিলটনের কবি-জীবনের প্রথম পর্বে “কোমাস”ই প্রথম কাব্য যার মধ্যে তার ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। কবির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের শুদ্ধাচারী মূল্যবোধ, পরবর্তীকালের মহত্তর কাব্যে যার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, এখানেই প্রথম বাণীরূপ গ্রহণ করল। কোমাস নাটক নয়, যদিও নাটকের সঙ্গে এই মাস্কের একটি কাঠামোগত শিথিল সম্পর্ক আছে।
বাহ্য ঘটনার দিক দিয়ে মিলটন জীবনে হর্টন পর্বের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। পিতার আশ্রয়ে, সংসার-ভাবনামুক্ত অবিবাহিত জীবনে কবি তার ভবিষ্যৎ কবি-কর্মের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। কবির দায়িত্ব সম্পর্কে তার অতি উচ্চ ধারণা ছিল, যা রেনেসাঁসেরই ধারণা। তাঁর কেম্ব্রিজ সহপাঠী এডওয়ার্ড কিং সমুদ্রপথে আয়ারল্যাণ্ড যাওয়ার সময় জাহাজডুবিতে মারা যান। তখন প্রয়াত বন্ধুর স্মরণে কেম্ব্রিজের সহপাঠীরা একগুচ্ছ কবিতা নিবেদন করেন। এর মধ্যে মিল্টনের শোকগাঁথা লীসিডাস (Lycidas 1637) একটি। এ কবিতায় শোক প্রকাশের সঙ্গে তার আরও একটি বক্তব্য আছে; অনিচ্ছুক হাতের রচনা এই কবিতা, এখনও তার প্রস্তুতিপর্ব চলছে। তার এই দীর্ঘ প্রস্তুতির সঙ্গে মিল খুঁজে পাই তার ভক্ত বাংলার কবি মাইকেল মধুসূদনের একই লক্ষ্যে একই ধরনের দীর্ঘ প্রস্তুতির।
ইতালি ভ্রমণে জন মিলটন
বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ হলে সেকালের ভদ্রসন্তানেরা বেরিয়ে পড়তেন এক ‘মহাদেশ-ভ্রমণে’। কার্যত এটা ছিল ইতালি ভ্রমণ, উদ্দেশ্য ছিল শিল্প-সংস্কৃতির পীঠভূমি ইতালিতে কিছুদিন বাস করে ও-দেশের ঐ সংস্কৃতির অর্জন নিয়ে ঘরে ফেরা। মিল্টন এবার, ১৬৩৮-এর এপ্রিল মাসে তার সেই বিলম্বিত বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেলেন। প্রায় দেড় বৎসরের এই যাত্রায় ইতালির বেশ কয়েকটি বড় শহরেই কমবেশি সময় কাটাবার সুযোগ পেলেন: এর মধ্যে ছিল জেনোয়া, লেঘর্ন, পিসা, ফ্লোরেন্স ও রোম। ফ্লোরেন্সে ছিলেন দুমাস, রোমেই সবচেয়ে দীর্ঘকাল। বিশেষত এই দুই শহরের বিদ্বজ্জন সমাজের সঙ্গে তাঁর মেলামেশার কথা, ইতালীয় সুধী সমাজে তার লাতিন কবিতার সমাদর, গৃহবন্দি গ্যালিলিওর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার—তাঁর বিভিন্ন গদ্য রচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন। ইতালিতে যখন এভাবে গুণীজন সান্নিধ্যে তার দিন কাটছে, খবর এলো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তার স্বদেশে। দেশের খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিলেন, ফিরে যাবেন। তবে এই দেশে ফিরে আসায় শেষ পর্যন্ত কোনো অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখা যায় না। বন্ধু দিওদাতির মৃত্যুর সংবাদ বিদেশেই পেয়েছিলেন। ফেরার পথে জেনিভায় বন্ধুর পিতৃব্য, বিখ্যাত ধর্মশাস্ত্রবিদ অধ্যাপক দিওদাতির সঙ্গে দেখা করেন। বন্ধুর স্মরণে লেখা তাঁর কবিতা, Epitaphium Damonis, তাঁর লাতিন কবিতাগুচ্ছের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ রচনা বলে গণ্য।
মিলটন রচিত On His Blindness কবিতাটি সম্পর্কে আলোচনা দেখুন ইউটিউব থেকে
জন মিল্টনের বৈবাহিক জীবন
১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মিলটন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন মেরি পাওয়েলের সঙ্গে। রাজতন্ত্রের সমর্থক পরিবারের কন্যা মেরির সঙ্গে মিলটনের দাম্পত্যজীবন সুখকর হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই মেরি পিতৃগৃহে ফিরে যান। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হন মিলটন। তাঁর প্রথমা স্ত্রী বিয়োগের বছরে ১৬৫২ সালেই অন্ধত্বের অভিশাপ নেমে আসে কবিজীবনে। ১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে মিলটন দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন। কিন্তু তার দ্বিতীয়া পত্নী ক্যাথরিন উডকক মারা যান ১৬৫৮তে।
তিনটি অল্পবয়স্ক কন্যা রেখে মিলটনের স্ত্রীর মারা যান ১৬৫২ সালে। এর আগে একটি শিশুপুত্র–কবির একমাত্র পুত্রসন্তান– জন্মের অল্পদিন পরেই মারা যায়। অন্ধ কবির পরিবারে, তার স্ত্রী-বিয়োগের পর, এক অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হলো, কিন্তু তার কর্মজীবনের ধারায় কোনো পরিবর্তন এল না। মিল্টন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ১৬৫৬ সালে, স্ত্রীর নাম ক্যাথারিন উডকক। দুঃখের বিষয় এই বিবাহ এক দুর্লভ সুখের আস্বাদ দিয়ে মাত্র পনের মাস পর, ১৬৫৮ সালে তাঁকে গভীরতর দুঃখের মধ্যে ফেলে দিল, স্ত্রী ও একটি শিশুকন্যা দুজনেরই মৃত্যু হলো ঐ বৎসর। এই স্ত্রী-বিয়োগের বেদনাই ধ্বনিত হয়েছে তার সনেটগুচ্ছের শেষ কবিতায়:
Methought I saw my late espoused Saint
১৬৬৩ সালে তৃতীয় বার বিবাহ করেন, স্ত্রী — এলিজাবেথ মিনশাল। এবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান ত্রিশ বৎসর। তৃতীয় স্ত্রীর গৃহিণীপনার গুণে তাঁর সংসারে আবার শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তার তৃতীয়া পত্নী এলিজাবেথ মিনশাল কবির মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন।
মিলটনের রাজনৈতিক চিন্তা
মিলটন এই সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তিনি ধর্ম সংস্কার, শিক্ষা, বিবাহ ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। এই সব প্রবন্ধাদির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য Reformation of Church Discipline in England.
মূল নিবন্ধ: জন মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা
দেশে শিক্ষার উন্নতি কিভাবে হতে পারে এই বিষয়ে মিলটন তার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন Tracte of Education নামক পুস্তিকায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৬৪৪ খ্রিঃ। এরপর মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা বিষয়ে তার Areopagitica গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরের বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার সঙ্কলন গ্রন্থ।
ল্যাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু ভাষায় মিলটনের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ক্রমওয়েল পার্লামেন্টের শাসন সরকারের ল্যাটিন সেক্রেটারির পদ বিদেশীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাজে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছর রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য মিলটনের কাব্য রচনার কাজ বিঘ্নিত হয়েছিল। মাত্র কয়েকটি সনেট ছাড়া আর কোনো কবিতাই তিনি রচনা করতে পারেন নি।[৩]
রাজতন্ত্রের পুনর্বাসন পরবর্তী জীবন
১৬৫৮ সালে লর্ডপ্রটেকটর ক্রমওয়েলের মৃত্যু হলে, রাজনৈতিক মঞ্চেও অস্থিরতা দেখা দিল। ১৬৫৯–৬০ সালে তিনি বর্বর ব্রিটিশ স্টুয়ার্ট রাজতন্ত্র পুনর্বাসনের সময় মিল্টন কিছুদিন অজ্ঞাতবাসে গেলেন, যেহেতু গ্রেফতারী পরোয়ানা তাঁর নামেও ছিল। এক সময় অল্পদিনের জন্য তিনি কারারুদ্ধ হন। ধারণা করা হয়, তার প্রাক্তন সহকারী, কবি অ্যান্ড্রু মার্ভেল-এর সুপারিশেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ভিন্ন মতে, এজন্য দায়ী স্যার উইলিয়াম ডেভন্যান্টের মধ্যস্থতা। স্যার উইলিয়ম ছিলেন শেক্সপীয়রের ধর্মপুত্র, এবং প্রাক্তন রাজ কবি। কবির বয়স ও অন্ধত্বও যে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার মধ্যে ছিল না, বলা যায় না।
এই সঙ্গেই শুরু হলো মিলটনের জীবনের তৃতীয় ও শেষ পর্যায়: কর্মচ্যুতি, অর্থাভাব, এক প্রায় নির্বাসিত জীবন। এবং যে আশা ও আদর্শ নিয়ে বিগত বিশ বৎসর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করলেন, নিজের ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তিও বিসর্জন দিলেন—সব কিছুর শোচনীয় সমাপ্তি ঘটল এক সকরুণ পরিণতির মধ্যে। কিন্তু এই দুঃখময় পরিস্থিতির মধ্যে কবি শেষ পর্যন্ত তার বহুদিনের ফেলে রাখা কাজ হাতে তুলে নেওয়ার অবকাশ পেলেন। কবিতায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি রেখে যাবেন, কৈশোরের এই অঙ্গীকার তিনি কোনোদিনই ভোলেন নি। এ জন্য তাঁর দীর্ঘ ও নিয়মবদ্ধ প্রস্তুতির কথা আগেই বলা হয়েছে। সরকারি কাজের বিশ বৎসরে যদিও কবিতা অবহেলিত হয়েছে, এবং অল্প কটি সনেটের অতিরিক্ত কিছুই ফলে নি তাঁর কলমে, তবু মনে হয় ওই পর্বের শেষ দিকে প্যারাডাইস লস্টের কিছু অংশ লেখা হয়েছিল। ১৬৫৮-র দিকেই তিনি তাঁর মহাকাব্যে হাত দিয়েছিলেন, অনেকের ধারণা রেস্টোরেশন যে আসন্ন বিপদ ডেকে এনেছিল, সেটা কেটে যাওয়ার পর মিল্টন আবার এক ধরনের অবসর জীবনে পুনর্বাসিত হলেন। এসময় লন্ডনে কয়েকবার পর পর বাসা বদলের খবর পাওয়া যায়। ১৬৬৩ সালের তৃতীয়বারের বৈবাহিক জীবনে এবার স্ত্রীর গৃহিণীপনার গুণে তাঁর সংসারে আবার শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এই সময়ের সঙ্কুচিত সামাজিক জীবনে তাঁর পাশে ছিল তিন কন্যা, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন, ও কিছু বন্ধু ও অনুরাগী ব্যক্তি।
আপাতদৃষ্টিতে এক হতমান ব্যক্তির বাধ্যতামূলক অবসরের জীবন—কিন্তু আসলে এটাই মিলটনের জীবনে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও গৌরবময় পর্যায়। এই সময়ে তিনি যে তিনটি কাব্য রচনা করেন, প্যারাডাইস লস্ট (১৬৬৭-তে প্রকাশিত), প্যারাডাইস রিগেইন্ড ও স্যামসন অ্যাগনিসটিজ (১৬৭১, একত্রে), সেগুলির রচনাকাল ও প্রকাশের সময় হিসাবে এই পর্বের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। তার এই সময়ের জীবনযাত্রা ও কবিতাকর্মের কিছু বিবরণ রেখে গিয়েছেন, অত্যন্ত কাছের মানুষ, তার ভাগিনেয় এডওয়ার্ড ফিলিপস ও সমকালীন লেখক ও সংক্ষিপ্ত জীবনীকার জন অব্রী। কবি শয্যা ত্যাগ করেন ভোর চারটায়, এবং তখন থেকে দুপুরের আহার পর্যন্ত পুরো সময়টাই লেখার কাজ চলে। তিনি মুখে বলে যান, একজন শ্রুতিলেখক সেটা লিপিবদ্ধ করেন—হয় তাঁর কোনো এক মেয়ে বা ভাগিনেয়। বা হাতের কাছে আর কেউ, যিনি হয়তো দেখা করতে এসেছেন। কখনো বা একজন মাইনে করা শ্রুতিলেখক। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার গদ্য-পদ্য সব কিছুই এভাবে লেখা হয়েছে।
ঘুম থেকে উঠে কবি মনে মনে বেশ কিছু পংক্তি তৈরি করেন, তারপর সকালের আলো ফুটলে, প্রাতঃরাশের পর, তিনি বলে যান, শ্রুতিলেখক লিখে নেয়। একটি আরাম কেদারায় কবি অর্ধ-শয়ান, তার একটি পা কেদারার ডানায় তোলা। এর পর শুরু হয় সংশোধন, সংক্ষিপ্তকরণ, যার ফলে প্রাথমিক রচনার ৫০-৬০-৭০ পংক্তি নেমে আসে পনের বা বিশ পংক্তির মধ্যে। এই ভাবেই জন্ম হয়েছিল জগতের অমর কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম Paradise Lost। বাইবেলের আদম আর ইভের স্বর্গচ্যুতির বিবরণকে অবলম্বন করে অন্ধ কবি মিলটন এই কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। বাইবেলের সেই সামান্য কাহিনীর মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের অনাবিল আত্মার আকুতিকে।
দুপুরের খাওয়া শেষে বাড়ির বাগানে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটেন, আবহাওয়া খারাপ হলে ঘরের মধ্যেই পায়চারী, বা দোলনায় দোলা। বিকেল চারটে থেকে একঘণ্টা সময় একেবারেই নিরিবিলি কাটে। তার পর কিছু সময় আত্মীয়, বন্ধু, অভ্যাগতদের জন্য নির্দিষ্ট। এসময় আলাপচারিতায় কবি বেশ খোশ মেজাজে থাকেন। তবে তার মধ্যে যে ব্যঙ্গপ্রবণ ব্যক্তিত্ব, সেটাও ধরা পড়ে কোনো কোনো শাণিত মন্তব্যে।
শেষের বৎসরগুলিতে তাঁর বাসগৃহে ভক্ত ও অনুরাগীদের ভিড় বাড়তে থাকে, এদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে চেনে কবি পরিচয়ে ততোটা নয়, যতটা সেই অতীতের পুস্তিকা যুদ্ধের বীর সেনানী হিসেবে। মেয়েদের সঙ্গে কবির সম্পর্ক এ-সময় খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে মেয়েরা সবাই নিজের পথ দ্যাখে।
অবসর-বিনোদনের নিত্যসঙ্গী ছিল মিলটনের সেই পুরাতন প্রেম, সঙ্গীত। নিজেও পিয়ানো বাজাতেন ভাল, বা আর কেউ বাজাতো, তিনি শুনতেন। গানের গলাও ভালো ছিল। যখন বাতের ব্যথায় কাতর, তখনও তাকে গান গাইতে শোনা যেত। রাতের আহার শেষে পাইপে এক ছিলিম ধূমপান করে, এক গ্লাস জল পান করে নটার মধ্যেই শয্যা গ্রহণ করতেন।
ছেষট্টি বছর বয়সে, ১৬৭৪ সালের ৮ই নভেম্বর মিলটন লণ্ডনে স্বগৃহে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সামান্য রোগভোগের পর একেবারেই নিঃশব্দ প্রয়াণ। কখন প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল, ঘরের লোক টেরও পায় নি। ক্রিপলগেইটের সেন্টজাইলস গীর্জায় তাঁর পিতার কবরের পাশে তাঁর কবর হলো।[৪]
তথ্যসূত্র:
১. কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, জে এন ঘোষ এন্ড সন্স, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৯৪-৯৬।
২. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, স্যামসন অ্যাগনিসটিজ, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, মার্চ ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১-১০।
৩. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১০৬-১০৮।
৪. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, পূর্বোক্ত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।