জন লক ছিলেন সপ্তদশ শতকের ইংরেজ বস্তুবাদী দার্শনিক ও রাজনৈতিক লেখক

জন লক (ইংরেজি: John Locke; ২৯ আগস্ট ১৬৩২ – ২৮ অক্টোবর ১৭০৪ খ্রি.) ছিলেন সপ্তদশ শতকের একজন ইংরেজ বস্তুবাদী দার্শনিক ও চিকিৎসক এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লেখক; যিনি আলোকায়ন যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত এবং সাধারণত “উদারতাবাদের জনক” হিসাবে পরিচিত। তখনকার ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সমাজ জীবনে যে শ্রেণিসংগ্রাম তীব্রভাবে সংঘটিত হচ্ছিল, লক তাতে প্রত্যক্ষভাবেই অংশগ্রহণ করেছিলেন।[১]

জন লকের প্রধান দার্শনিক রচনা হচ্ছে ‘এসে কনসারনিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা মানুষের জ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধ। এর প্রকাশকাল ১৬৯০। এই নিবন্ধে লক তাঁর বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদের জ্ঞানতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লক দেকার্তের জন্মগত ভাব এর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। লকের মতে, অভিজ্ঞতাপূর্ব বা জন্মগত কোনো ভাবের অস্তিত্ব নেই। মানুষের মনের সব ভাবেরই মূল হচ্ছে বাস্তব অভিজ্ঞতা।

লকের মতে ভাব দুপ্রকার হতে পারে। মৌল এবং অ-মৌল বস্তুজগত সর্বক্ষণ মানুষের ইন্দ্রিয়ের উপর আঘাত হানছে। এই আঘাতের মাধ্যমে মনের মধ্যে ইন্দ্রিয়গত ভাবের উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তি অবশ্য তার নিজের মানসিক ক্রিয়াকলাপের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু মনোগতভাবেরও সৃষ্টি করতে পারে। ‘মনোগত ভাবের’ স্বীকৃতি দ্বারা লক জ্ঞানের প্রশ্নে ভাববাদী তত্ত্বের সঙ্গে খানিকটা আপোস করতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলে জ্ঞানের তত্ত্বে লককে অবিমিশ্র বাস্তব অভিজ্ঞতাবাদী বা ইন্দ্রিয়গত ভাববাদী বলে তুলনা করা চলে না। লকের মতে ইন্দ্রিয়গত ভাব দ্বারা আমরা বস্তুর মৌলিক বা অ-মৌলিক গুণের জ্ঞান লাভ করি। ‘শক্তত্ব’ বস্তুর একটি মৌলিক গুণ। কিন্তু রং তার একটি অমৌলিক গুণ।

ভাবমাত্রই জ্ঞান নয়। বাস্তবজগতের অভিজ্ঞতা থেকে ইন্দ্রিয় যে ভাব সংগ্রহ করে তা জ্ঞানের কাঁচামালবিশেষ। এই কাঁচামালের উপর মনের তুলনা, বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জ্ঞানের সৃষ্টি। এই প্রক্রিয়াতেই মন সহজ থেকে জটিল ভাবের সৃষ্টি করে। মানুষের মনে জন্মগত কোনো ভাব থাকে না। কারণ শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তার মন একখানি নিখাদ শ্লেট বা ‘টেবুলা রাসা’ ব্যতীত আর কিছু নয়। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বস্তুজগত শিশুর ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে এই নিদাগ শ্লেটে অসংখ্য দাগ কেটে দিতে থাকে। নিদাগ শ্লেটে বস্তুজগতের এই দাগই হচ্ছে ভাব বা জ্ঞানের কাঁচামাল।

মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতা কতখানি, এটি দর্শনের একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। লক জ্ঞানের সীমাকে অসীম বলেন নি। বস্তুজগৎ এবং অ-বস্তুজগতের অনেক কিছুই মানুষ হয়ত জানতে পারে না। কিন্তু তাই বলে মানুষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসহায় নয়। লক জ্ঞানের সীমাকে স্বীকার করলেও তিনি অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন না। তাঁর কাছে জ্ঞানের মূল প্রশ্ন হচ্ছে, জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন। এরূপ জ্ঞানলাভের ক্ষমতা মানুষের অবশ্যই আছে।

রাষ্ট্রীয় তত্ত্বে লক মানুষের আদিম অবস্থা থেকে সভ্যতার উত্তরণের স্তরসমূহের উপর আলোকপাত করেন এবং সরকারের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ব্যক্তি-রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নটি সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের ধনিক শ্রেণীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ধনিক শ্রেণী আপন বিকাশের জন্য একটি সামাজিক বিপ্লব সাধন করে। তাদের কাছে রাষ্ট্রের ভূমিকা নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং তাদের সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের মধ্যে নিহিত থাকবে। সরকারের কর্তব্য হবে ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করা। অধিকার হরণ করা নয়। এই ভূমিকাকে লঙ্ঘন করে রাষ্ট্র বা সরকার স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করলে নাগরিকেরও অধিকার থাকবে সে রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার সামাজিক ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাবার।

সামাজিক, রাজনীতিক ও দার্শনিক প্রশ্নসমূহের প্রগতিশীল ও বাস্তববাদী সমাধানে লকের চিন্তাধারার প্রভাব তৎকালে সুদূরপ্রসারী ছিল। পরবর্তীকালে ফরাসি দেশে যে বস্তুবাদী দর্শন বিকাশ লাভ করেছিল, তার প্রেরণার উৎস ছিল লকের ভাবধারা। লক বস্তুর মৌলিক ও অ-মৌলিক গুণের মধ্যে যে পার্থক্য স্বীকার করেছিলেন তাঁর সে পার্থক্যের ভিত্তিতেই আবার ভাববাদী দার্শনিক ধর্মযাজক বার্কলে জ্ঞানকে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির মানসিক বোধে পর্যবসিত করার প্রয়াস পান।[২]

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ১৮ জুন, ২০১৯, “জন লক ছিলেন সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের বস্তুবাদী দার্শনিক ও লেখক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/john-locke/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৬৬-২৬৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!