জ্যাক দেরিদা (ইংরেজি: Jacques Derrida, ১৫ জুলাই ১৯৩০ – ৯ অক্টোবর ২০০৪) একজন আলজেরীয়-বংশোদ্ভূত প্রতিক্রিয়াশীল ফরাসি দার্শনিক ছিলেন। তিনি মূলত বিশ শতকের শেষার্ধের সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের পক্ষের অর্থাৎ জনগণ, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শত্রু গণহত্যাকারী রাষ্ট্রসমূহের ফ্যাসিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দর্শনের প্রচারক। জ্যাক দেরিদা পড়লে মনে হবে যে, দুনিয়াতে শোষণ-সাম্রাজ্যবাদ-যুদ্ধ-মুনাফা ইত্যাদি বলে কিছু নেই; আছে শুধু আপনা থেকে তৈরি হওয়া হাঙ্গামা বা অশান্তি।
জ্যাক দেরিদা বিগঠন দর্শনের বিকাশ করেছিলেন, যা তিনি বহু গ্রন্থে ব্যবহার করেছিলেন এবং যা ফার্দিনান্দ দ্য সসুর ও হুসারলিয়ান এবং হাইডেগারিয়ান ঘটনাবিদ্যার ভাষাতত্ত্বের ঘনিষ্ঠ পাঠের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছিল। তিনি পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদী দর্শনের সাথে যুক্ত একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব, যদিও তিনি পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন এবং “উত্তর আধুনিকতা শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন”।
তার কর্মজীবনে, দেরিদা শতাধিক প্রবন্ধ এবং জন-উপস্থাপনাসহ ৪০টিরও বেশি বই প্রকাশ করেছিলেন। দর্শন, সাহিত্য, আইন, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস রচনা, ফলিত ভাষাতত্ত্ব, সমাজভাষাবিদ্যা, মনোবিশ্লেষণ, সঙ্গীত, স্থাপত্য এবং রাজনৈতিক তত্ত্বসহ মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের উপর তার উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব ছিল।
তার কাজ সাম্রাজ্যবাদী সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণহত্যাকারী মহাদেশীয় ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অন্যান্য সমস্ত দেশে যেখানে মহাদেশীয় দর্শন প্রাধান্য পেয়েছে, বিশেষ করে অন্টোলজি, জ্ঞানতত্ত্ব (বিশেষত সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত), নীতিশাস্ত্র, নন্দনতত্ত্ব, ব্যাখ্যাশাস্ত্র বা হারমেনিউটিক্স এবং ভাষার দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে বিতর্কে প্রধান একাডেমিক প্রভাব ধরে রেখেছে।
একটি ভিডিও দেখুন
বেশিরভাগ ইংরেজিমণ্ডলে, যেখানে বিশ্লেষণাত্মক দর্শনের প্রাধান্য রয়েছে, দেরিদার প্রভাব বর্তমানে সাহিত্যের অধ্যয়নে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় কারণ ভাষার প্রতি তার দীর্ঘকালের আগ্রহ এবং ইয়েলে তার সময় থেকে বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচকদের সাথে তার সংযোগের কারণে। তিনি স্থাপত্য (ডিকনস্ট্রাকটিভিজমের আকারে), সঙ্গীত (বিশেষ করে হন্টোলজির সঙ্গীত আবহে), শিল্প এবং শিল্প সমালোচনাকে প্রভাবিত করেছিলেন।
জ্যাক দেরিদা ১৯৩০ সনের ১৫ জুলাই আলজেরিয়ার এল বিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্যারিসের প্রখ্যাত Ecole normale Superieure-এ পড়াশুনো করেন এবং সেখানেই ১৯৬৪ সনে দর্শনের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তার Speech and Phenomena (১৯৭৩), Writing and Difference (১৯৭৮) এবং Of Grammatology (১৯৭৬) গ্রন্থ প্রকাশের পরপরই তিনি ফরাসি চিন্তার জগতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৮ সন থেকে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৭৪ সন থেকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।[১]
ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা সাম্প্রতিক ইউরোপীয় দর্শন, ভাষা এবং সাহিত্যে নিজের চিন্তার বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষত তার ‘বিগঠন’ পদ্ধতি উল্লেখ্য। এতে কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কোনো বিষয় বা বিষয়সমূহ অবদমিত, ত্যজিত, বর্জিত, বিযুক্ত, অপেক্ষিত হয়েছে তা বুঝানোর জন্য ঐ পদ্ধতিকে উল্টে বিপ্রতীপ কৌশল প্রয়োগ করা হয়।
দেরিদীয় বিগঠন (ইংরেজি: decnstruction) অনুযায়ী কোনো আলোচনা বা রচনাকর্মে বিধৃত দার্শনিক অবস্থান বিপ্রতীপ হয়ে যায়। দেরিদার মতে পাশ্চাত্য দর্শনের ভিত্তি হলো ধীকেন্দ্রিকতা। এ হলো তাৎপর্য, সত্য, যুক্তি, জ্ঞানের ক্রমস্তরিক ভিত্তিমূলক ধারণা। তাৎপর্য/প্রকরণ, আপতিকতা/আকস্মিকতা (essence/acceident), গুরুত্বপূর্ণ/গুরুত্বহীন, আক্ষরিক/ব্যঞ্জনাত্মক, স্বাতিক্রমণিক/অভিজ্ঞতামূলক,—এসব বিভাজনে রয়েছে উচ্চস্তরিক স্বাতন্ত্র্য। এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে, আসক্ত শব্দদ্বয়ের প্রথমটিই আদি বা মূল বা অগ্রবর্তী; দ্বিতীয়টি হলো প্রথমটি থেকে আহরিত, প্রথমটির জটিল প্রকাশ কিংবা প্রথমটির পরিবর্তিত যুগপৎ রূপায়ণ। এই আসক্ত স্বাতন্ত্র বা বৈপরীত্যকে অবিনির্মাণ করার উদ্দেশে প্রথমে শব্দদ্বয়ের উচ্চস্তরিক পরম্পরাকে উল্টে দিতে হবে। দেখাতে হবে, প্রথম শব্দটিই দ্বিতীয়টির পরিবর্ত (veriant)। কারণ দ্বিতীয় শব্দটিতে এমনসব বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়েছে, যার ফলে পরবর্তী হলো অগ্রবর্তী এবং কখনোই এর উল্টোক্রম গ্রাহ্য হবে না। অর্থাৎ আক্ষরিকের বিশেষ রূপ হিসেবে ব্যঞ্জনাত্মক (যার ব্যঞ্জনাধর্ম বিস্মৃত হয়েছে) গ্রাহ্য হবে না।
দেরিদা তার De la grammatologie বা Of Grammatology গ্রন্থে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন, কথা ও রচনা (speech and writing)। চিন্তাবিদেরা ভাষার সরাসরি স্বাভাবিক রূপ হিসেবে গণ্য করেন কথাকে। তাদের মতে, কথা বলা বা বক্তৃতা দেওয়ার সময়ের জীবন্ত অবস্থাকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে লিখিত ‘রচনা’ কেবল দুর্বল বিকল্প। এভাবে তারা ভাষার জটিল বৈশিষ্ট্যকে অবদমিত করেন। কেননা তারা ভাষার একটি আদর্শায়িত নমুনার উপর ভিত্তি করেন, বিশেষত নির্ভর করেন কোনো ব্যক্তির কথা-বলা শোনার অভিজ্ঞতার উপর—এতে তাৎপর্য যুগপৎ উপস্থিত রয়েছে মনে হয়। রচনাকে নৈর্ব্যক্তিক, ফাকা ধারণকৌশল হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য দেখানো যায়, এই একেবারেই ফাকা পৌনঃপুনিকতার ক্ষমতা সকল চিহ্নেরই শর্ত এবং কথা বা বাচ্য হলো রচনার বা বিশেষ রচনারই ভিন্ন প্রকাশ। অর্থাৎ সংকীর্ণ অর্থে কথা এবং রচনা উভয়েরই শর্ত হলো ঐ ফাঁকা পৌনঃপুনিকতা। এই বৈপরীত্য ধীকেন্দ্রিক উচ্চস্তরতাকে ধ্বংস করে দেয় এবং ধীকেন্দ্রিক ধারণা থেকে অবদমিত ভাষার বিভিন্ন দিককে অবদমন থেকে মুক্ত করে। তাঁর মতে “পাঠের বাইরে কিছুই নেই”।
সংক্ষিপ্তভাবে জ্যাক দেরিদা-এর অবদান হলো: (১) পাশ্চাত্য দর্শনে ধীকেন্দ্রিকতার প্রাসঙ্গিকতা বা স্থায়িত্ব এবং এর অনিবার্য অসামঞ্জস্য বা স্ববিরোধকে ব্যাখ্যা করা; (২) আপাত প্রান্তিক উপাদানের গুরুত্ব এবং বর্জন ও অবদমনের (exclusion and repression) উপর পদ্ধতির নির্ভরশীলতা; (৩) সাহিত্য সমালোচকদের জন্য ভাষা ও কূটাভাষ বা বৈপরীত্য ব্যাখায় সৃজনশীল এবং রচনাকর্মের অলঙ্কার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দার্শনিক চিন্তাধারায় নতুন এক আলোচনা পদ্ধতি প্রবর্তন, (৪) তার কৃত অন্যান্য তত্ত্বের অবিনির্মাণ থেকে প্রমাণ হয়, তাৎপর্য ভাষা উৎসৃষ্ট, ভাষার উৎস থেকে জাত নয়; তাৎপর্য কখনোই সম্পূর্ণ নিরূপিত নয়, কারণ তাৎপর্য পরিপ্রেক্ষিতে অনায়ত্ত বা অবর্ণিত (that cannot be curcumscribed) শক্তিসমূহেরই ফল। (৫) তার চিন্তাধারা অনেক বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। যেমন তার মতে উৎস, বর্তমান বা উপস্থিতি, অহম (self) ইত্যাদি বাস্তব ভিত্তি নয়, ফল।
জ্যাক দেরিদা-এর প্রধান সমস্যা হচ্ছে তিনি ভাষার উপরে গুরুত্ব দিলেও বস্তু এবং বস্তুর পরিবর্তনশীলতা এবং গতিময়তা বুঝতে পারেননি। বস্তুর গতি না বোঝার কারণে সমাজের পরিবর্তনশীলতা তিনি বোঝেননি, এই কারণে তাঁকে আমরা প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক বলছি। দেরিদার প্রথম দিককার রচনাতে প্লেটো, কান্ট, রুশো, হেগেল, হুসাল, ফ্রয়েড প্রমুখ সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। কিন্তু, তার Glas (১৯৭৪), La verite en peinture (১৯৭৮), La carte postale (১৯৮০) ইত্যাদি পরবর্তী সময়ের রচনাতে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বরং সাহিত্যিক। তার রচনাবলি সাহিত্য ও দর্শনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা এবং দুইয়ের সীমাকে অনেকটা অতিক্রম করে যায়।[২]
আরো পড়ুন
- নোয়াম চমস্কি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মার্কিন দার্শনিক
- মার্শাল ম্যাকলুহান ছিলেন কানাডীয় প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক
- হার্বার্ট মারকুস মার্কসবাদবিরোধী আবর্জনা সৃষ্টিকারী জার্মান-মার্কিন দার্শনিক
- জ্যাক দেরিদা ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল ফরাসি দার্শনিক
- অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক পরমত সহিষ্ণু গণতন্ত্রমনা সমাজচিন্তক
- আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এক প্রজ্ঞার প্রতিমূর্তি
- জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক এবং মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা
- মাও সেতুং ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাম্যবাদী বিপ্লবী
- আল্লামা মহম্মদ ইকবাল ছিলেন একজন মুসলিম লেখক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ
- লেনিন ছিলেন বিশ শতকের ইউরোপের মহত্তম মানব এবং মার্কসবাদের উত্তরসূরি
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা ভাষার লেখক, কবি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ
- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণির নেতা
- মানবেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক
- কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয় ছিলেন রাশিয়ার সবচেয়ে প্রতিভাধর লেখক
তথ্যসূত্র:
১. দোলন প্রভা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, “জ্যাক দেরিদা প্রতিক্রিয়াশীল ফরাসি দার্শনিক”, রোদ্দুরে.কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/jacques-derrida/
২. আফজালুল বাসার; বিশ শতকের সাহিত্যতত্ত্ব; বাংলা একাডেমি, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১; পৃষ্ঠা ৩০৩-৩০৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।