ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ বা ইভান পাভলভ (ইংরেজি: Ivan Petrovich Pavlov, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৪৯ – ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ খ্রি.) ছিলেন রুশ দেশের একজন বিখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী, শরীরতত্ত্ববিদ যিনি তাঁর ধ্রুপদী প্রতিবর্ত ক্রিয়া বিষয়ক গবেষণার জন্য পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেহতত্ত্ব বা মেডিসিনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে ১৯০৪ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।[১]
ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ প্রথম রুশ নোবেল বিজয়ী ছিলেন। ২০০২ সালে প্রকাশিত সাধারণ সাইকোলজির রিভিউ-এর একটি সমীক্ষায় পাভলভকে বিশ শতকের ২৪তম সর্বাধিক উল্লেখ করা মনোবিজ্ঞানী হিসাবে স্থান দেওয়া হয়েছিল। ধ্রুপদী প্রতিবর্ত ক্রিয়া সম্পর্কিত পাভলভের নীতিগুলি বিভিন্ন আচরণের চিকিতসা জুড়ে এবং পরীক্ষামূলক এবং ক্লিনিক সম্বন্ধীয় পটভূমিতে যেমন শিক্ষামূলক শ্রেণিকক্ষ এবং এমনকি পদ্ধতিগত বিসংবেদনশীলতাসহ ফোবিয়াস হ্রাস করতে দেখা গেছে।
পাভলভের প্রধান খ্যাতি কুকুরের রিফ্লেক্স এ্যকশন বা প্রতিবর্ত ক্রিয়ার গবেষণাকে কেন্দ্র করে। তার এই গবেষণা থেকে তিনি প্রাণীর “সাপেক্ষ প্রতিবর্ত” ব্যাখ্যাকারী সূত্র প্রদান করেন। এই গবেষণার মাধ্যমে পাভলভ মানুষ এবং পশুর মস্তিষ্কের সঙ্গে বাইরের উত্তেজকের সম্পর্কের বিধান আবিষ্কার করেন। পাভলভের প্রতিবর্ত ক্রিয়ার তত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বস্তুবাদী এবং আচরণবাদী গবেষণা ও ব্যাখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।[২]
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার প্রসঙ্গে পাভলভ
কেন লালা ঝরে?
এ যেন সেই কেন আপেল মাটিতে পড়ার মতো প্রশ্ন! অথচ ওই প্রশ্ন থেকেই পাওয়া গেল এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সূত্র।
পরীক্ষাটা চলছিল হজম ক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু তারই মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটল যাতে মূল পরীক্ষা ছেড়ে পরীক্ষকের মনে জাগল প্রশ্ন! কেন লালা ঝরে?
এই কেন লালা ঝরে প্রশ্নটা উঠতেই তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, যে লোকটি কুকুরটাকে খাদ্য দেয়, তার পায়ের শব্দ শুনলেই অথবা থালা বাসনের কাজ হতে থাকলেই কুকুরটা যেন উত্তেজিত হতে থাকে। তার জিভ থেকে অবিরাম ঝরতে থাকে লালা। আর সেটা দেখেই পাভলভ তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে যুক্ত করলেন আরো একটি গবেষণার ধারা।
হ্যাঁ, ওই পরীক্ষকের নাম ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ। বিখ্যাত রুশ শারীর বিজ্ঞানী তিনি। হজম ক্রিয়া নিয়ে বিশেষ ধরণের গবেষণা করেছিলেন তিনি। আর সেই সময়ই কুকুরের লালা ঝরা দেখে প্রশ্ন জাগল। কেন লালা ঝরে? সেই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গিয়েই তিনি প্রবেশ করলেন মনোবিজ্ঞানের অন্দরমহলে। মনোরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ধারা প্রবর্তন করলেন তিনি।
ফেরা যাক কুকুরের সেই লালা ঝরার প্রসঙ্গে। নিজের মনকে দিয়েই পাভলভ কুকরের মনকে বোঝার চেষ্টা শুরু করলেন। আর সেই বোঝার সূত্রেই সিদ্ধান্তে এলেন। খাদ্য পরিবেশক লোকটির পায়ের শব্দ অথবা থালাবাসনের আওয়াজ পেলেই কুকুরটি বুঝতে পারে এবার তাকে খাবার দেওয়া হবে। তাতেই উদীপ্ত হয়ে ওঠে কুকুরটি। তার লালাও ঝরতে থাকে।
এই সিদ্ধান্তে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পাভলভের মনে প্রশ্ন জাগলো। তিনি যা বুঝেছেন তা ঠিক, কিন্তু তাতে যতক্ষণ না বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, ততক্ষণ তো তা বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। তাঁর প্রশ্ন, কুকুর যে মানুষের মত চিন্তা করতে পারে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কোথায়? তাছাড়া মস্তিষ্কের মধ্যে কোন ক্রিয়া বিক্রিয়ার জন্য কুকুরের লালা ঝরবে? এক্ষেত্রে মনের ভূমিকা কি? মনন ক্রিয়াই কী লালা ঝরার কারণ?
পাভলভ তাঁর প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার জন্য এমন একটি রাস্তা বেছে নিলেন যা তাঁর আগে বড় একটা কেউ নেননি। তিনি কুকুরের ওপর ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার করে তার লালা গ্রন্থিটিকে শরীরের বাইরে এনে চামড়ার সঙ্গে সেলাই করে দিলেন। কুকুরটি সুস্থ হওয়ার পর পাভলভ শুরু করলেন তাঁর পরীক্ষা। গ্রন্থিটি বাইরে রাখার পর বাইরে থেকে নিঃসরণ পর্যবেক্ষণ এবং তা পরিমাপ করা সম্ভব হলো।
এই লালা ঝরা ব্যাপারটি যে উচ্চ মস্তিকের ক্রিয়া সে সম্পর্কে পাভলভ নিশ্চিত ছিলেন, এবার সেই উচ্চ মস্তিকের ক্রিয়াকলাপের নিয়মকানুন ঠিক করার পদ্ধতিটিও আবিস্কৃত হলো। মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের হদিশ নেবার প্রচেষ্টার শুরু এখান থেকেই।
পাভলভ দেখলেন, ঘণ্টা বাজানো হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে খাবার দেওয়া হচ্ছে কুকুরকে—তার লালা ঝরছে। বেশ কয়েকবার এরকম করার পর শুধু ঘণ্টা বাজানো হলো—তাতেও কিন্তু লালা ঝরাতে থাকলো কুকুরটির—সে খাবার জায়গায় যাবার জন্য ছটফট করছে। এখানেই বলা হলো কণ্ডিশন্ড রিফ্লেক্স বা শর্তাধীন পরিবর্ত। সাধারণের ভাষায় খাবার দেখে জিবে জল আসার ব্যাপারটাকেই বলা হলো সহজাত আদিম জৈব ক্রিয়া। এর জন্য আলাদা কোনো শিক্ষার দরকার দরকার হয় না।
পাভলভ এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বললেন ঘটার শব্দ উচ্চ মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্রে উদ্দীপনা জাগায়। সেই উদ্দীপনার সঙ্গে সহজাত আদিম জৈব ক্রিয়ার দরুণ নিম্ন মস্তিষ্কের উদ্দীপনার যোগাযোগ ঘটার ফলেই পরবর্তীকালে শুধু ধ্বনি শুনেই লালা পড়তে থাকে। তবে কয়েকবার যদি ঘন্টা ধ্বনির পর খাবার না আসে তাহলে কিন্তু লাল কমতে কমতে একবারে শূন্যে দাঁড়াবে। এই সূত্রেই তিনি আনকন্ডিশাণ্ড রিফলেক্সের কথাও বললেন। যেগুলো কোনোরকম শর্ত ছাড়াই জীব শেখে।
যাই হোক, এই ঘণ্টাধ্বনি, কুকুরের লালা ঝরা একে নিয়ে গবেষণা করেই পাভলভ মনোবিজ্ঞানের একটি কার্যকর নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটল পাভলভের এই গবেষণাকে কেন্দ্র করেই।
জন্ম ও শিক্ষাজীবনে পাভলভ
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়ার রিয়াজান শহরে পাভলভের জন্ম। ত্রিশ বৎসর বয়সে ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতক হন। ডাক্তারি পাশ করে তিনি সরাসরি চিকিৎসার দিকে না ঝুঁকে গবেষণার দিকেই নজর দিলেন বেশি। সুযোগও জুটে গেল। বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী বতকিলের গবেষণাগারে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে এক নাগাড়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ফলে তাঁর মধ্যে যে বৈজ্ঞানিক প্রতিভা ছিল তারও বিকাশ ঘটতে থাকে।
এরপর তিনি পাঁচ বছর ছিলেন সামরিক চিকিৎসাবিদ্যা আকাদেমির ভেষজ শাখার অধ্যাপক পদে। ৩০ বছর কাল তিনি ওই পদেই ছিলেন। এরই মধ্যে প্রয়োগাত্মক চিকিৎসা বিদ্যা সংস্থার অধিকর্তাও হন তিনি। ১৯০৪ সালে তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় পেলেন নোবেল পুরস্কার। পাচনতন্ত্রের গ্রন্থি সম্পর্কে গবেষণার জন্য তাঁকে ওই পুরস্কার দেওয়া হয়।
পাভলভ ছিলেন মনে প্রাণে বিজ্ঞানী। সংস্কারমুক্ত মনের অধিকারী পাভলভ ছিলেন প্রগতির সমর্থক। কিন্তু সেই সময়কার অর্থাৎ জারের আমলের রাশিয়া এইরকম প্রগতিবাদী মানুষকে সহ্য করতে পারত না কোনোভাবেই। তাই তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে নানাভাবেই বাধা সষ্টির চেষ্টা করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতন্ত্র। কিন্তু তা সত্বেও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্র থেকে পিছু হটেন নি পাভলভ। এবং বাধা যত এসেছে, ততই তিনি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেছেন নিজের পথে।
সোভিয়েত বিপ্লবের পর সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে অবশ্য পাভলভের কাজ হয় অনেক অবাধ। তাঁর গবেষণা কাজে উৎসাহ এবং সাহায্য দেবার জন্য সরকার এগিয়ে দেন উদার হাত! ১৯৩৪ সালে পাভলভ হন উচ্চতর স্নায়ু নির্ভর ক্রিয়ার শারীরবিদ্যা এবং নিদানতত্ত্ব সম্পর্কিত সংস্থার অধিকর্তা। তাঁরই উদ্যোগে ১৯৩৫ সালে লেনিনগ্রাদে এবং মস্কোভায় পঞ্চদশ আন্তর্জাতিক শারীর বিদ্যা সম্মেলন হয়। আর এরই এক বছর বাদে ১৯৩৬ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি চির কর্মচঞ্চল বিজ্ঞানী পাভলভের মৃত্যু হয়।
পাভলভের গবেষণার ধারাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৯ সাল অর্থাৎ চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে পড়া শুরু করার পর থেকে প্রথম ১৫ বছর তিনি প্রধানত হৃৎপিণ্ড ও রক্ত সঞ্চালনের স্নায়ুঘটিত নিয়ন্ত্রণ নিয়েই গবেষণা করেন। এরই মধ্যে ১৮৮৭ থেকে প্রায় দশ বছর তাঁর গবেষণা চলে পরিপাক নিয়ে। এরপর অর্থাৎ ১৯০৪ থেকে ১৯৩৬ সাল বা মৃত্যু পর্যন্ত তিনি কিন্তু দেহ ছেড়ে মন এবং মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
অভ্যাস লব্ধ প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স নিয়ে তাঁর গবেষণা বিজ্ঞান জগতে একটি সম্পূর্ণ নতুন দিকের উন্মোচন করে। শুধু তাই নয়, এই সময় তাঁর পরীক্ষা শারীর বিদ্যার গবেষণার ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। এই সময় তিনি অস্ত্রোপচার করে প্রাণী দেহে জানালার মত ফোকর তৈরি করে সুস্থ প্রাণীর অঙ্গ বিশেষের ক্রিয়া কলাপ দেখতেন। পাভলভ কোনো খণ্ডিত অঙ্গ অথবা মৃত প্রাণী নিয়ে গবেষণার বিরোধী ছিলেন তাই তাঁর সব পরীক্ষাই চলে জীবিত প্রাণীর ওপর।
তাঁরই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে মস্তিষ্ক নির্ভর মনোবিদ্যা গড়ে ওঠে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনও সমৃদ্ধ হয় এবং মনোরোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার দ্বারও খুলে যায়। পাভলভ বলেন, মানব চৈতন্য সমেত সমস্ত মননক্রিয়া মস্তিষ্কের ওপর বহির্জগতের প্রতিফলন মাত্র।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব যেমন মনোবিদ্যার একটি দিককে সমৃদ্ধ করেছে ঠিক একইভাবে পাভলভের গবেষণাও মনোবিদ্যাকে আর একটি সমৃদ্ধ নতুন ধারার পথে নিয়ে গেছে।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ৪ আগস্ট ২০১৯, “ইভান পাভলভ ছিলেন বিখ্যাত রুশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/ivan-petrovich-pavlov/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০৫।
৩. তুষারকান্তি পাণ্ডে সম্পাদিত, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী, গ্রন্থনা কলকাতা, ১৯৯০-৯১, পৃষ্ঠা ৩২৬-৩২৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।