আইজাক নিউটন বা স্যার আইজ্যাক নিউটন (ইংরেজি: Issac Newton; ৪ জানুয়ারী ১৬৪৩ – ৩১ মার্চ ১৭২৭) ছিলেন একজন ইংরেজ গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং লেখক (তাঁর সময়ে “প্রাকৃতিক দার্শনিক” হিসাবে বর্ণিত) যিনি সর্বকালের সেরা গণিতবিদ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের মূল ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বিশ্ববরেণ্য এই ইংরেজ বৈজ্ঞানিককে বলবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়।[১] নিউটন বস্তুজগতের সর্বক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। দার্শনিক চিন্তার বিকাশকেও তিনি বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছেন। তাঁর মূল গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘ফিলসফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা।’ ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা’ হিসাবে এ গ্রন্থ সর্বজনীনভাবে পরিচিত। তাঁর সর্ব-ব্যাপক মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব সূর্য কেন্দ্রিক সৌরমন্ডলের চিন্তাকে যেমন পরিপূর্ণতা দান করে তেমনি এ তত্ত্ব সমগ্র বিশ্বের সকল বস্তু জগৎ এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়াসমূহকেও ব্যাখ্যার উপায় প্রদান করে।
দর্শনের ক্ষেত্রে নিউটন সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব এবং মানুষের পক্ষে বিশ্বজগতের জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। অবশ্য কালের প্রেক্ষিতে তিনি বস্তুর মূল গতি ঈশ্বর হতে এসেছে বলে মনে করেন। কিন্তু তত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর ঘোষণা, অনুমানের উপরে আমি কোনো কথা বলি নে, ‘হাইপথেসিস ননফিঙ্গো’ অষ্টাদশ শতকের বিজ্ঞানের বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপে বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশে নিউটনের অবদান অবিস্মরণীয়। জ্ঞানের অসীমতার ক্ষেত্রে তাঁর উক্তি, ‘আমি জ্ঞান সমুদ্রের তীরে উপলখন্ড সংগ্রহ করে চলেছি’ গভীর দার্শনিক তাৎপর্যে পূর্ণ অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি।[২]
প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেকার ঘটনা। একদিন রাত্রে লিঙ্কনশায়ারের মানুষ আকাশের দিকে চেয়ে চমকে উঠেছিল। ওই বুঝি দেখা দিয়েছে নতুন কোনও ধূমকেতু। আর ধূমকেতু মানেই তো অমঙ্গল। যুদ্ধ, মহামারী, শস্যহানি। কিছুক্ষণ দেখার পরেই অবশ্য তাদের ভুল ভেঙেছিল। আরে! ওটা তো একটা ঘুড়ি, লেজের সঙ্গে বাঁধা একটা কাগজের লণ্ঠন! এত রাতে কে ওড়াচ্ছে ওই আলো-লাগানো ঘুড়ি! কে আবার? উলসথর্পের সেই ‘পাগল’ ছেলেটা।
পাগল তো বটেই। কৃষকের ছেলে। জন্মানোর আগেই বাপকে খুইয়েছে। মায়ের হয়ে কোথায় খেতখামার দেখবে, বাজারে গিয়ে কেনাবেচা করবে, তা নয়। হয় বইয়ে মুখ গুজে পড়ে আছে, নয় তো আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একা। আর যত সব উদ্ভূটে তার খেলা। এক শরতের বিকেলে প্রচণ্ড ঝড় উঠল। গোল বাছুর, খামারের শস্য সামলানোর জন্যে লোকজন নিয়ে তার ছুটোছুটি করার কথা। কিন্তু দেখা গেল, ১০ বছরের সেই বালক ঝড়ের হাওয়ার উলটো দিকে বারবার লাফ দিচ্ছে। আসলে ছেলেটি তখন ওইভাবে ঝড়ের শক্তি মাপার চেষ্টা করছিল। প্রতিটি লাফের পর কত দূরে গিয়ে পড়ছে, তা মেপে দেখছিল। কেউ ভাবে, ও ছেলের কিছু হবে না। আবার কেউ কেউ তার কুশলী হাতে মাথা খাটিয়ে তৈরি এটা-সেটা যন্ত্রপাতি দেখে মনে করে, ছেলেটি খুব সাধারণ নয়। নাম তার আইজ্যাক। কে জানত, সেই ছেলেই একদিন আইজ্যাক নিউটন নামে এক বিশ্ব বরেণ্য, সম্ভবত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে পরিচিত হবেন।
আইজ্যাকদের পরিবার কৃষক হলেও, তারা ছিল যথেষ্ট সম্পন্ন। জমিজিরেত ছিল প্রচুর। আইজ্যাকের ঠাকুরদা রবার্ট নিউটন ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারে উলসথর্প মৌজা কিনে নেন। লর্ড উপাধিও পান। সেই সুবাদে সমাজের উচ্চস্তরে উঠে আসেন। অথচ, লেখাপড়া তো দূরের কথা, নিজের নামটাও সই করতে পারতেন না তিনি। রবার্ট নিউটন তার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে হান্নার সঙ্গে। কিন্তু দুঃখের কথা, বিয়ের এক বছর পরেই তিনি মারা যান। আইজ্যাক তখনও মাতৃগর্ভে। জন্মের পর বাবার নামেই তার নামকরণ হয় ‘আইজ্যাক’। আইজ্যাক নিউটনের জন্ম উলসথর্পে, ১৬৪২ সালের বড়দিনে গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ১০০ বছর পরে।
আইজ্যাকের ছেলেবেলাটা কিন্তু ভাল কাটেনি। তার তিন বছর বয়েসে মা আবার বিয়ে করে আইজ্যাককে তার বাপের বাড়িতে রেখে চলে যান নতুন স্বামীর ঘর করতে। দাদু জেমস এই সময় তার নাতিটিকে তেমন স্নেহের চোখে দেখতেন না। তিন থেকে দশ, সাতটা বছর স্নেহ-ভালবাসা থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিল আইজ্যাক। আর তাই ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছিল, হয়তো বা জেদিও। আপন মনে একলা থাকা অথবা বই পড়া— এই ছিল তার নেশা। তবে মামাবাড়ি শিক্ষিত বলে শিক্ষাদীক্ষার শুরুটা অবশ্য ভালই হয়েছিল। দাদু তাকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। আইজ্যাকের যখন ১০ বছর বয়েস, সে-সময় তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীও মারা যান। মা উলসথর্পে ফিরে এসে ছেলেকে ফের নিজের কাছে নিয়ে আসেন। যাতে খেতখামার দেখাশোনার কাজ সে আস্তে আস্তে শিখে নিতে পারে। কিন্তু ছেলের সে দিকে একেবারেই মন নেই। তখন হান্না তার ভাই উইলিয়মের পরামর্শে আইজ্যাককে পড়তে পাঠান আট কিলোমিটার দূরে গ্রান্থামের গ্রামার স্কুলে। উইলিয়াম ছিলেন কেমব্রিজের স্নাতক। তিনি চেয়েছিলেন, ভাগনেও স্কুল পাশ করে কেমব্রিজে ভর্তি হোক। চাষবাস নয়, লেখাপড়ার দিকেই যাক।
গ্রান্থামে আইজ্যাক প্রথম দিকে তেমন সুবিধে করতে পারেনি। একদিন তারই ক্লাসের বড়সড় একটি ছেলে রোগাসোগা আইজ্যাককে টিটকিরি দিলে সেও ঘুসি মেরে তার জবাব দেয়। ছেলেটির গায়ের জোর তুলনায় অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও, তেজ আর ক্ষিপ্রতার জোরে আইজ্যাক দেওয়ালে তার নাক ঘষে দিয়ে একেবারে কাত করে দেয় তাকে। এর পর লেখাপড়াতেও টেক্কা দেওয়ার জন্যে আইজ্যাক উঠেপড়ে লাগে। অল্প সময়ের মধ্যে সে হয়ে ওঠে ক্লাসের সেরা ছাত্র। গ্রান্থামের স্কুলে অবশ্য ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা এবং কিছুটা গণিত ছাড়া আর কিছুই শেখার সুযোগ হয়নি। তবে ল্যাটিন ভাষা শেখার সুফল মিলেছিল পরবর্তিকালে বিজ্ঞানচর্চায়। সে সময় সারা ইউরোপে জুড়ে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় ল্যাটিনের কদরই ছিল সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে বইপত্রও লেখা হতো প্রধানত ল্যাটিনেই। নিউটন তার শ্রেষ্ঠ গবেষণা গ্রন্থ ‘প্রিন্সিপিয়া’ লিখেছিলেন এই ভাষাতেই।
গ্রামার স্কুলের পড়া শেষ না হতেই আইজ্যাককে স্কুল ছাড়িয়ে উলসথর্পে নিয়ে এসে ফের খেতখামার দেখাশোনার কাজে লাগিয়ে দেন তার মা। তত দিনে সে গ্যালিলেওর ডায়ালগ এবং বিজ্ঞানী দেকার্তের বইপত্র পড়ে ফেলেছে। গণিতে তার অসামান্য প্রতিভা ধরা পড়েছে শিক্ষকদের কাছে। ফলে জমিজিরেত দেখাশোনার বদলে বই পড়া, একলা চিন্তা আর যন্ত্রপাতি তৈরিতেই তার দিন কাটে। মা বাধ্য হয়ে তাকে ফেরত পাঠান গ্রান্থামে। কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুল-পাশ করে তরুণ আইজ্যাক ভর্তি হন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। আইজ্যাকের জীবনে পালা বদলের সেই শুরু।
কেমব্রিজেও নিউটনের প্রথম এক দেড় বছর বেশ কষ্টে কেটেছিল। মায়ের কাছ থেকে খরচ বাবদ পেতেন বছরে মাত্র ১০ পাউন্ড। তাতে চলত না, ‘সিনিয়ার ফেলো’ অর্থাৎ বৃত্তিধারী অগ্রজ ছাত্রদের ফাইফরমাশ খেটে বাড়তি রোজগার করতে হত। পাশাপাশি চলছিল একান্ত নিজস্ব পড়াশোনা এবং বিজ্ঞানচিন্তা। প্রায় প্রতি রাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে চেয়ে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন, তাদের গতির হিসেব লিখে রাখতেন নোটবুকে! সম্ভবত এ সময়েই প্রথম ক্যালকুলাসের ধারণা তার মাথায় আসে। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের হলেও, গণিতে তার অসাধারণ মেধা অধ্যাপক ও সহপাঠীদের কাছে ধীরে ধীরে প্রকাশ হয়ে পড়ে। ১৬৬৪ সালে একটি বৃত্তি পান নিউটন। পরের বছরেই বি এ ডিগ্রি। ঠিক তার পরই কেমব্রিজে প্লেগ মহামারীরূপে দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। নিউটন ফিরে আসেন উলসথর্পে।
উলসথর্পে প্রায় দু’বছর থাকতে হয়েছিল নিউটনকে। আর সেই দুটি বছরই অসামান্য এক তরুণ বিজ্ঞানীর জীবনের স্বর্ণসময়। নতুন নতুন চিন্তা ও আবিষ্কারে মগ্ন ছিলেন তিনি। তখনকার কথা স্মরণ করে পরবর্তিকালে নিউটন লিখেছেন, সে সময়টা ছিল উদ্ভাবনের পক্ষে একেবারে আদর্শ। বয়েসটাও সঠিক। তখন গণিত ও বিজ্ঞান নিয়ে যতটা মগ্ন ছিলাম, তেমনটি আর কখনও ঘটেনি। নিউটন তখন ২৪ বছরের যুবক।
১৬৬৭ সালে প্লেগ মহামারী আপন নিয়মেই কেটে গেলে নিউটন ফিরে এলেন কেমব্রিজে। ১৬৮৮ সালে এম এ ডিগ্রিও পেয়ে গেলেন। পরের বছরই মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ‘লুকাসিয়ান প্রফেসর’ নিযুক্ত হলেন। হেনরি লুকাস নামে এক বিদ্যোৎসাহীর অর্থে ১৬৬৩ সালে ওই অধ্যাপক পদের সৃষ্টি হলে তাতে প্রথম নিযুক্ত হন আইজ্যাক ব্যারো। তিনি একাধারে গ্রিক ভাষাবিদ ও গণিতজ্ঞ ছিলেন। শোনা যায়, ১৬৬৪ সালে অধ্যাপক ব্যারোর বক্তৃতাবলি নিউটনকে প্রথমত গণিতে এবং গণিত থেকে স্বাভাবিক পথেই বিজ্ঞানের গভীর চিন্তা ও গবেষণায় আকৃষ্ট করেছিল। তার সহপাঠী ও বন্ধু ইউকিনস তার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, সে সময় নিউটন পড়াশোনায় এত বেশি মগ্ন থাকতেন যে কোনও কোনও দিন খেতেও ভুলে যেতেন। হয়তো সারারাত ধরে বই পড়ছেন, রাতের খাবার টেবিলে পড়ে আছে যেমনকার তেমনই। পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও তার কোনও খেয়াল থাকত না। এভাবেই নানা ঘটনার সূত্রে ‘অ্যাবসেন্টমাইন্ডেড প্রফেসর’ অর্থাৎ ভুলো অধ্যাপক বলে তিনি পরিচিত হয়ে যান।
লুকাসিয়ান অধ্যাপক হওয়ার পর নিউটনের আর্থিক দুরবস্থার অবসান হয়। তিনি আরও নিবিড়ভাবে গবেষণায় মন দেন। আলোর ধর্ম নিয়ে নিউটনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল কেমব্রিজে বি এ পড়তে পড়তেই। ঘরের সমস্ত জানলা কপাট বন্ধ করে একটি মাত্র ছিদ্র দিয়ে আসা আলোকধারার পথে প্রিজম রেখে উলটো দিকের দেওয়ালে দেখেছিলেন সাত রঙের বর্ণালি। আবার ওই বর্ণালির আলোকগুলি উলটোভাবে বসানো প্রিজমের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত করে দেখলেন সাত রং মিশে ফের সাদা হয়ে গেল। এভাবেই নিউটন প্রথম প্রমাণ করেন যে, সাদা আলো আসলে বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা আর লাল আলোর মিশ্রণ। তার আগে বিজ্ঞানীরা সাদা আলোকে ‘বিশুদ্ধ’ মনে করতেন। নিউটনের পর অবশ্য লাল আর বেগুনি ছাড়িয়েও অনেক অদৃশ্য (যেমন অবলোহিত, অতিবেগুনি) আলোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
নিউটনের মহাকর্ষীর তত্ত্ব আবিষ্কারের সঙ্গে আপেল পড়ার গল্পটি বহুল প্রচলিত। আসলে গাছ থেকে একদিন টুপ করে একটি আপেল পড়ল আর অমনই তিনি পৃথিবীর অভিকর্ষীয় টান আবিষ্কার করে ফেললেন, ব্যাপারটা অত সরল নিশ্চয়ই ছিল না। প্লেগ মহামারীর তাড়ায় যখন উলসথর্পে দিন কাটছে, সে সময়েই একদিন রাত্রে বাগানে বসে চাঁদের দিকে চেয়ে যখন ভাবছিলেন কীসের আকর্ষণে চাঁদ একই কক্ষপথে দিনের পর দিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, তখনই তাঁর মাথায় খেলে যায়, গাছ থেকে আপেলের পতন আর পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের ঘূর্ণনের পিছনে কারণ একটাই। যা মহাশূন্য পেরিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল দূরের চাঁদ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ হলো পৃথিবীর এক অমোঘ টান, যার নাম ‘গ্র্যাভিটি’ বা অভিকর্ষ। সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলি যে ঘুরছে, তার পিছনেও আছে সূর্যের অভিকর্ষ। আসলে এই টান সর্বব্যাপী, মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তুই একে অন্যকে এক অদৃশ্য শক্তিতে টানছে। নিউটন যার নাম দিলেন ‘ইউনিভার্সাল গ্র্যাভিটেশন’ বা মহাকর্ষ। তার আগে এ ধরনের কোনও একরকম টানের কথা বিজ্ঞানীরা একেবারে যে ভাবেননি, তা নয়। কিন্তু নিউটন এই ধারণাকে দৃঢ় বৈজ্ঞানিক যুক্তির ওপর দাঁড় করিয়ে একটা গাণিতিক সূত্র দিলেন। যার নাম ‘ল অফ গ্র্যাভিটেশন’। এই সূত্রটি কী, তা আমরা প্রায় সকলেই জানি।
বস্তুর গতি নিয়েও নিউটন তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যেখানে বস্তুর গতিধর্মের সঙ্গে ‘ফোর্স’ বা বলের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। আর এই সমস্ত আবিষ্কার নিয়েই তিনি লেখেন বিজ্ঞানের এক মহাগ্রন্থ। ল্যাটিন ভাষায় লেখা বইটির নাম: ‘ফিলজফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’। সংক্ষেপে ‘প্রিন্সিপিয়া’।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী বন্ধু এডমন্ড হ্যালির অনুপ্রেরণায় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বইটি প্রকাশিত হয় ১৬৮৭ সালে। নিউটনের বয়েস তখন ৪৫। কিন্তু তার ২০ বছর আগেই ওই সব আবিষ্কার তিনি করে ফেলেছেন। খ্যাতির প্রতি কোনও মোহ ছিল না বলে প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করেননি। এর পরেও আলো সংক্রান্ত আবিষ্কার নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘অপটিকস’। তত দিনে বিজ্ঞানী হিসেবে নিউটনের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা ইউরোপে। প্রতিফলক দূরবীন উদ্ভাবন করে তরুণ বয়েসেই তিনি রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হতে পেরেছিলেন। ৬৭ বছর বয়েসে তিনি ওই সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হন। এবং ২০ বছর এই পদে থাকাকালীন সংগঠনটিকে তিনি প্রকৃত বিজ্ঞানমুখী করে তোলেন।
একান্ত বিজ্ঞানসাধনার বাইরে জনজীবনেও নিউটনের প্রবেশ ঘটেছিল। কেমব্রিজের অধ্যাপনা ছেড়ে ‘রয়াল মিন্ট’ অর্থাৎ ইংল্যান্ডের টাকশালের ওয়ার্ডেনের চাকরি নেন। পরে টাকশালের প্রধান হন। এ দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও নির্বাচিত হয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এ সব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ইংল্যান্ডের রাজা তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তরুণ বয়েস থেকেই অতি পরিশ্রমের ফলে শেষ দিকে নিউটনের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ ৮৫ বছর বয়েসে এই কালজয়ী বিজ্ঞানীর প্রয়াণ ঘটে। ২৮ মার্চ তাকে রাজকীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে। সেই অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ফরাসি চিন্তাবিদ ও লেখক ভলতেয়ার যার বর্ণনা দিয়েছেন এই ভাবে, এ হলো প্রজাদের হাতে এক কীর্তিমান রাজার শেষকৃত্য।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ৪ জুলাই, ২০১৯, “আইজ্যাক নিউটন হচ্ছেন ইংরেজ বৈজ্ঞানিক ও বলবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/issac-newton/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৯৩-২৯৪।
৩. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ৮০-৮৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।