ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা (ইংরেজি: Ishwar Chandra Vidyasagar; ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলা অঞ্চলের একজন বাঙালি সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, গদ্য লেখক এবং একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তার বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম ভগবতী দেবী। পান্ডিত্যের জন্য তাদের পরিবারের খ্যাতি ছিল, কিন্তু আর্থিক অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলি কেটেছিল কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে।
আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ঠাকুরদাসকে অল্প বয়সেই বীরসিংহ গ্রাম ছেড়ে অর্থোপার্জনের জন্য কলকাতায় যেতে হয়। সেখানে নামমাত্র বেতনে এক ব্যবসায়ীর খাতা লেখার কাজে নিযুক্ত হন। ন্যায়নিষ্ঠা, সততা, অধ্যবসায় ও স্বাধীনচেতা মনোভাব সম্বল করে তিনি কালক্রমে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পিতার এই সব গুণ পরবর্তিকালে পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যেও পূর্ণমাত্রায় দেখা গেছে।
কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে হলেও ঈশ্বরচন্দ্রের মনোবল ছিল অসীম। গ্রামের পাঠশালার পড়াশুনায় কখনো অমনোযোগী হননি।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে বাংলা ১২৩৫ সনের শেষ দিকে তিনি বাবার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। সেই সময় তার বয়স নয় বছর। কথিত আছে, পথে আসতে আসতেই তিনি অসাধারণ মেধা বলে ইংরাজি সংখ্যা এক থেকে দশ পর্যন্ত শিখে নিয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় বড়বাজার অঞ্চলে ভাগবতচরণ সিংহের বাড়িতে বাবার সঙ্গে বাস করতে থাকেন। ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে। অপরিসীম অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে তিনি স্কুলের পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং মাসিক পাঁচ টাকার বৃত্তি লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের পাঠানুরাগ এমনই ছিল যে তেলের অভাবে ঘরে আলো জ্বালাতে না পারলে পথের ধারে গ্যাসের আলোতে বসে পড়া তৈরি করতেন। এমনি অবিরাম কষ্টের মধ্যেই তাকে স্কুলের পড়া চালাতে হয়েছিল।
ব্যাকরণ শ্রেণির পাঠ শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র ইংরাজি শ্রেণিতে পড়া আরম্ভ করেন। এরপর সাহিত্য শ্রেণির পাঠ শেষ করেন ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। সাহিত্য শ্রেণিতে তিনি কৃতি শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালংকারের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর ভর্তি হন অলংকার শ্রেণিতে। এই শ্রেণিতে তিনি এক বছর পড়াশুনা করেন। এবারেও পরীক্ষায় প্রথম হয়ে প্রচুর পুরস্কার লাভ করেন। এরপর যথাক্রমে বেদান্ত শ্রেণি ও স্মৃতিশ্রণিতে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, জ্যোতিষ এবং ন্যায়শাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু ল’ কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার বিদ্যাসাগর উপাধিটি পরীক্ষার শেষে প্রশংসাপত্রে তার নামের আগে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যাসাগর বিয়ে করেন পনের বছর বয়সে। তার স্ত্রীর নাম দিনময়ী দেবী।
১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় কর্মজীবন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। এত কম বয়সে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করা বিদ্যাসাগরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। উক্ত কলেজের সেক্রেটারি জি. টি. মার্শালের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও বিশেষ সুপারিশে তা সম্ভব হয়ে ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পাঁচ বছর কর্মনিযুক্ত ছিলেন তিনি।
১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদকের পদে যোগদান করেন। সেই সময়ে কলেজের সম্পাদক ছিলেন রসময় দত্ত। সেই বছরেই বিদ্যাসাগর শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি বিধানে এক মূল্যবান রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন। এ বিষয়ে সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মতবিরোধ উপস্থিত হলে তিনি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে চাকরি ছেড়ে দেন।
পুনরায় যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজে। সম্পাদক জি.টি. মার্শালের আগ্রহে প্রথমে তিনি কলেজের প্রধান করনিকের পদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পরে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ লাভ করেন।
১৮৫৬ খ্রিঃ এই কলেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে বিদ্যাসাগরকে ওই পদে নিযুক্ত করা হয়। এবারে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পান। কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ও অন্যান্য সংস্কারমূলক কাজে মনোনিবেশ করেন। কলেজের কর্তৃপক্ষ তার কর্মনিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে তার মাসিক বেতন ১৫০ টাকার স্থলে ৩০০ টাকা করে দেন। এই সময় অতিরিক্ত কাজ হিসাবে বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্বও তাকে বহন করতে হয়।
বিদ্যালয় পরিদর্শকের কর্তব্য পালনের জন্য বিদ্যাসাগরকে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হতো। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো পাঞ্জীতে চেপে। এই সময়ে বাংলার গ্রামের মানুষের অশিক্ষা ও কুসংস্কার প্রত্যক্ষ করে তিনি খুবই মর্মপীড়া বোধ করেন।
সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
গ্রামবাসীদের শিক্ষার উন্নতির জন্য তিনি দুমাসের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কুড়িটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেই সময়ে নারীশিক্ষা খুবই অবহেলিত ছিল। বিদ্যাসাগর বুঝতে পারেন স্ত্রীজাতির উন্নতি এবং সমাজের উন্নতির জন্য নারীজাতির যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
তারই অক্লান্ত চেষ্টায় মেয়েদের জন্য সর্বপ্রথম বাংলার গ্রামে গ্রামে ত্রিশটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বিদ্যাসাগরের উদ্যম ও কর্মনিষ্ঠা দেখে বাংলার ছোটলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডে মুগ্ধ হন এবং বিদ্যাসাগরের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ উঠে গিয়ে সেখানে স্থাপিত হল বোর্ড অব এগজামিনার্স। বিদ্যাসাগরকে বোর্ডের সক্রিয় সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হলো। এই সময় ফ্রেডারিক হ্যালিডের ইচ্ছায় বঙ্গদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলির সহকারী পরিদর্শকের পদ লাভ করেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের সঙ্গেই তাকে এই কাজ করতে হতো।
বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে এবং কয়েকজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির চেষ্টায় মধ্য কলকাতায় ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সমিতির সদস্য। ক্রমে তিনি সম্পাদক পদে ব্রতী হন।
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন। পরবর্তিকালে এই প্রতিষ্ঠানেরই নাম হয় বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয়।
শিক্ষা সংস্কারের পাশাপাশি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের কাজও আরম্ভ করেছিলেন। নারীজাতির দুর্গতি মোচনকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তারই অক্লান্ত চেষ্টায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হয়।
এই কাজ করতে গিয়ে তাকে সমাজের রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। নিজের পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিয়ে তিনি এই আইনের বাস্তবতার নজীর স্থাপন করেন। বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রয়াসেরই ফলে সমাজে বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথা কমে যায়।
বিদ্যাসাগরকে বলা হয় বাংলা গদ্যের জনক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে এই অভিধায় ভূষিত করেন। তিনি সংস্কৃত হিন্দী ও ইংরেজি থেকে বহু গ্রন্থ অনুবাদ করেন। অনুদিত গ্রন্থের মধ্যে সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস, বেতাল পঞ্চবিংশতি এবং কথামালার গল্প সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া তার রচিত বর্ণ পরিচয়, বোধোদয় এবং আখ্যানমঞ্জরী গ্রন্থগুলি আজও শিক্ষার গোড়াপত্তনে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।
বিশাল ও বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ বিদ্যাসাগর ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ডের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাকে সি.আই.ই উপাধিতে সম্মানিত করেন।
কঠোর পরিশ্রমজনিত কারণে বিদ্যাসাগরের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। তাই অবশিষ্ট জীবন তিনি বিহারের অর্ন্তগত কর্মাটারে কাটান। সাঁওতালদের অনাড়ম্বর সরল জীবনযাত্রা তাঁকে মুগ্ধ করে। তাদের অবহেলিত অবস্থা দেখে তিনি তাদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই এই মহামানব লোকান্তরিত হন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ২৩-২৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।