ইন্দুসুধা ঘোষ (১৯০৫ – ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের নারী বিপ্লবী। তিনি বৈচিত্রময় জীবন গড়ে তুলেছিলেন। রাজনীতি, ছবি আঁকা, সাহিত্যচর্চাসহ নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাজনীতি জীবনে প্রায় ছয় বছর জেল খেটেছিলেন।[১]
জন্ম ও শিক্ষা জীবন:
ইন্দুসুধা ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহে। বাবার বাড়ি ঢাকা জেলার বজ্রযোগিনীতে। তার পিতা সতীশচন্দ্র ঘোষ ও মাতা প্রিয়কুমারী দেবী। তাঁর বাবা পেশায় সরকারি কর্মচারী ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতেন তিনি। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলে পড়তেন। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। সেখানে ছবি আঁকা ও সেলাইতে নিয়মিত পুরস্কার পেতেন। সোনার মেডেলও পেয়েছেন।
কবি রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হন। প্রতিমা দেবী তার হাতের কাজের প্রদর্শনী দেখেতে আমন্ত্রণ জানান শান্তিনিকেতনে। তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে আচার্য নন্দলাল বসুর ছাত্রীরূপে ১৯২৬ সাল থেকে চার বছর কলাশিল্পে শিক্ষালাভ করেন।
ইন্দুসুধা ঘোষ-এর কর্মজীবন:
আচার্যের উৎসাহেই তৈরি করেন ‘কারুসজ্ঞ’ এবং প্রকাশিত হয় তার নক্সার বই ‘সীবনী’। ১৯৩০ সালে শ্রীনিকেতন শিক্ষাসদনে চাকরিতে যোগ দেন ইন্দুসুধা ঘোষ।
তার কাজ ছিল গ্রামের মানুষকে তাদের অজ্ঞানতা এবং অসচেতনতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল করানো; তা তাদের দুর্গতির অন্ধকার থেকে জ্ঞান ও শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা।
১৯৩৮ সালে এলাহাবাদ মিউনিসিপাল মহিলা শিল্পভবনে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়ে ৯ বছর কাজ করেন।
রাজনৈতিক কাজ:
পিসতুতো দাদা কিরণ রায় ইন্দুসুধাকে বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯২৬ সালে তিনি বিপ্লবী যুগান্তর-দলের কর্মীদের প্রভাবে এসে রাজনৈতিক কর্মে অনুপ্রাণিত হন এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হন।
নিষিদ্ধ পুস্তক রাখা, রিভলভার রাখা এবং সংগঠন করার দায়িত্ব ছিলো তার উপর; শান্তিনিকেতন তার পক্ষে নিরাপদ স্থান ছিলো।
১৯৩২ সালে স্টেটসম্যান সম্পাদক ওয়াটসনকে গুলি করার ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক কর্মীদের তিনি চন্দননগর, কলিকাতা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়দান করেন।
পরে পুলিশ তার সম্বন্ধেও এত তৎপর হয়ে ওঠে যে, অবশেষে ইন্দুসুধা ঘোষকেই পলাতক হয়ে জলপাইগুড়ির সামসিং নামে এক চা বাগানে চলে যেতে হয়।
পুলিশ সেখান থেকে খুঁজে বার করে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯৩২ সালের অক্টোবর মাসে। কিন্তু প্রমাণভাবে তিনি মামলা থেকে মুক্তি পান। তারপর তাকে ডেটিনিউ করে প্রেসিডেন্সি ও হিজলী জেলে আটক রাখে। ১৯৩৭ সালে তিনি মুক্তি পান।
ইন্দুসুধা ঘোষ-এর জেল জীবন:
হিজলী জেলের কঠিন নীরস দিনগুলি যখন বন্দীদের কাছে দুর্বহ হয়ে উঠত তারা ইন্দুসুধা ঘোষের ছোট্ট সেলটির কাছে গেলে যেন একটি শান্ত স্নিগ্ধ মধুর পরিবেশ লাভ করতেন।
ছবি সকলে আঁকতে জানে না, বুঝতেও পারে না। কিন্তু ইন্দুসুধা ঘোষের ছবি আঁকবার ঘরখানিতে যে কেউ যেতেন তার মনটা যেন একাট রস সৃষ্টির ও নূতনত্বের স্বাদ পেত।
যে শুষ্ক মন সেই ঘরে ঢুকেছিল সে-মনটা ফিরে আসবার সময় স্নিগ্ধ রসস্নাত হয়ে বেরিয়ে আসত। ইন্দুসুধা জেলে গিয়েছিলেন যেন অন্য বন্দীদের কঠিন জীবনযাত্রায় আনন্দস্পর্শ দান করতে।
বন্দীরা ভাবতেন, আচার্য নন্দলালের ছাত্রীই যদি এমন, তবে রসের উৎস সেই আচার্য না জানি কি। শুধু ছবি আঁকা নয়। ইন্দুসুধা ঘোষের ছিল একটি ছোট্ট বাগান।
তাঁর রজনীগন্ধার ঝাড় কঠিন লাল মাটিতে তেমন কিছু ঝোপে ঝাড়ে বেড়ে ওঠে নি বটে, কিন্তু কারাগারে সেদিন দুটি রজনীগন্ধা এবং চারটি বেলফুল ফুটলেও মনে হত স্বর্গের সুষমা যেন বাগানটিতে ছড়িয়ে আছে।
তারি মাঝে বসে ইন্দুসুধা ছোট্ট একটি খুরপি হাতে নীরস কঠিন মাটি খুঁড়ছেন, বুঝি ওইখানে পাবেন তিনি অজানা রহস্যের সন্ধান। বন্দী ছাড়া ঐ দৃশ্যের মাধুর্য অন্যের বুঝবার সাধ্য নেই।
ইন্দুসুধা ঘোষের ‘এপ্রিল ফুল’ করবার কাহিনীটুকু না বললে তার কথা অপূর্ণ থেকে যাবে। ময়দা আর রঙ দিয়ে প্রকাণ্ড এক সাপ বানিয়ে রেখে এলেন তিনি চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা ইন্দুমতী সিংহের খাটের তলায়।
রাতে শুতে গিয়ে সেটা দেখে সকলে মিলে তারস্বরে চীৎকার “সাপ! সাপ!” বাইরে থেকে ছুটে এল জমাদার, সিপাই। খাটের ডাণ্ডা দিয়ে সিপাইরা ছাতু-ছাতু করে ফেলল সাপটা! ইন্দুসুধা ঘোষ হেসে গড়াগড়ি। জেলের মধ্যে রসের আধার ছিলেন তিনি।
শেষ জীবনের কাজ:
১৯৪৮ সালে ‘নারীসেবা সঙ্ঘ’ নামের এক সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আবাসিক সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত হয়ে কলকাতায় আসেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেখানে তিনি টানা ৩০ বছর কাজ করেন। ১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।[২]
তথ্যসূত্র:
১. দোলন প্রভা, ২৮ জুন, ২০১৮, “ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগান্তর দলের বিপ্লবী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/biography/indusudha-ghosh/
২. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১৬৮-১৬৯। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।