ইমানুয়েল কান্ট ছিলেন অষ্টাদশ শতকের জার্মান ভাববাদী দার্শনিক ও বিজ্ঞানী

ইমানুয়েল কান্ট (ইংরেজি: Immanuel Kant; ২২ এপ্রিল ১৭২৪ – ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৪) ছিলেন অষ্টাদশ শতকের জার্মান বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং আলোকায়ন যুগের কেন্দ্রীয় চিন্তাবিদদের একজন। জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র এবং নন্দনতত্ত্বে কান্টের ব্যাপক এবং পদ্ধতিগত কাজ তাকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।[১]

দর্শনবিদ্যায় তাঁর বিপুল অবদানের মধ্যে রাষ্ট্রদর্শনেরও বেশ কিছুটা অংশ ছিল। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস। সরকার, সংবিধান ইত্যাদি বিষয় অপেক্ষা আইন, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা অথবা মানবাধিকারের প্রত্যয় তাঁর চিন্তায় বেশি প্রাধান্য পায়। রুশোর প্রভাবে রাষ্ট্রের প্রত্যয় এবং মন্টেস্কুর প্রভাবে সরকারের প্রতায় দানা বাঁধে।[২]

জার্মানিতে সনাতন ভাববাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তার খ্যাতি। জার্মানির কনাইবাগ শহরে তার জন্ম। জীবনের পরবর্তী সময়ে এই কানাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেন। কান্ট ভাববাদী দার্শনিক হিসাবেই অধিক পরিচিত। তাঁর ভাববাদকে অপরাপর ভাববাদ হতে পৃথক করে ক্রিটিকাল অর্থাৎ বিচারবাদী বা বৈচারিক বা ট্রান্সেগুন্টাল বা অতিক্রমী ভাববাদ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। কান্টের দার্শনিক জীবনকে আমরা বৈচারিক-পূর্ব এবং বৈচারিক-উত্তর যুগ হিসাবে বিভক্ত করতে পারি।[৩]

দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তায় কান্ট

কান্টের ভাববাদী উত্তরসাধক ফ্রিডরিখ হেগেল রাষ্ট্রকে একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকার দেন। পক্ষান্তরে কান্ট ছিলেন উদারতাবাদের উদগাতা। তাঁর কাছে ব্যক্তিমানুষ ছিল লক্ষ্য, মাধ্যম নয়। তাঁর মতে মানুষ যুক্তিশীল এবং সাম্য ও স্বাধীনতা যুক্তিশীল মানুষের মৌল সত্তা। তিনি একদিকে চাইতেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, অন্যদিকে তিনি ছিলেন বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বিরোধী। প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারি বিধিব্যবস্থায় জোরালো সমর্থন থেকেই তাঁর গণতন্ত্রী ও উদারনৈতিক মনোভঙ্গি প্রকাশ পায়।

রুশোর বাস্তব তথা গণ-অভীপ্সার প্রভাব কান্টের রাষ্ট্রদর্শনে নৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে মূলবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যয়টির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো যে মানুষের প্রকৃতি দ্বিবিধ: একদিকে তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ইচ্ছা ও অনুভূতি। অন্যদিকে অতীন্দ্রিয় সত্তা যেটা তার নৈতিক ও যুক্তিশীল আত্মবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং যেটা তাকে উচিতকর্মে প্রণােদিত করে। অতীন্দ্রিয় সত্তার ফলে মানুষ ব্রহ্মের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। সেই সুত্রেই মানুষ নৈতিক স্বাধীনতা পায়।

মুলত নৈতিক স্বাধীনতার প্রত্যয় ও মানুষের ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতির উপর কান্টের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। রুশোর সামাজিক চুক্তি প্রত্যয়টিকে তিনি নিজের ভিন্ন দৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে রাষ্ট্রের অনুগত করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। তবে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিবর্তনেও তাঁর সায় ছিল না। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করলেও রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে সীমিত রাখাই ছিল তাঁর অভিমত। তাঁর নৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন ব্যক্তির নিজস্ব আবেগ ও কর্তব্যের বিষয়, রাষ্ট্রের নয়। সুন্দর জীবনের প্রতিবন্ধকতাকে অপসারণ করাই রাষ্ট্রের কাজ। লোকের নৈতিক স্বাধীনতায় কোনও রকম হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের পক্ষে অনুচিত।

কান্ট ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। ব্যক্তির অধিকার হলো তার নৈতিক স্বাধীনতার অঙ্গ এবং অপরের অনুরূপ অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিশীল। অপরের স্বাধীনতাকে কোনওভাবে ব্যাহত না করে ব্যক্তিমানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। সম্পত্তির ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার অর্জিত, সহজাত নয়। অধিকারের সঙ্গে মানুষের অনেক দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে ।

কান্টের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষের একটি যুক্তিশীল অভীপ্সা থাকে যেটা অন্যান্য আত্মসর্বস্ব ইচ্ছা, চাহিদা ও অনুভূতি থেকে স্বতন্ত্র। সেই যুক্তিশীল অভীপ্সাই মানুষের প্রকৃত পরিচয়, যেটা মূলত নীতিসম্মত ও স্বাধীন এবং রাষ্ট্র ও তার আইনকানুনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। রাজনীতির সঙ্গে নৈতিকতার পরিমিশ্রণ ঘটিয়ে কান্ট রাষ্ট্র, আইন, অধিকার সম্পত্তি ইত্যাদির এক নবরূপায়ণ করেন। রাজনীতি, নৈতিকতা ও আইনকানুনের মূলে সত্যকে স্থাপন করাই ছিল তাঁর আদর্শ।

কান্টের রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে স্থায়ী শান্তির প্রত্যয়টি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি মনে করতেন যে বিভিন্ন জাতি তথা রাষ্ট্র মানুষের মতই প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদবিরোধে লিপ্ত হয়। তাই প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য, সুশীল সমাজের মতে যেখানে ব্যক্তির অধিকার সুনিশ্চিত, অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি থাকা উচিত। কালক্রমে সব রাষ্ট্রেরই সেনাবাহিনী লুপ্ত হওয়া আবশ্যক। তাঁর দৃষ্টিতে সামরিক প্রস্তুতি ও সম্প্রসারণের কারণ হলো বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক বাজার দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তারপর ঘটে উপনিবেশের অধিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, শোষণ ও নিপীড়ন, দুর্ভিক্ষ, বিদ্রোহ ইত্যাদি। ফলে সারা বিশ্বে শান্তি বিঘ্নিত হয়।

কান্ট মনে করতেন যুদ্ধবিগ্রহ নিবারণ ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠাতাকল্পে প্রথমত সব দেশে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, এবং দ্বিতীয়ত স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সংঘবদ্ধতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন প্রণীত হওয়া প্রয়োজন, নইলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। তাই থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তিন ধরনের শান্তিমূলক আইন চাই: ১. সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক আইন; ২. আন্তর্জাতিক আইন এবং ৩. সর্বজনীন বিধিবিধান। বস্তুত উত্তরকালে কান্টের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় প্রতিফলিত হয়।

বৈচারিক-পূর্ব যুগে সত্তার প্রশ্নে কান্ট বাস্তব সত্তা এবং যুক্তিগত সত্তার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার প্রয়াস পান। এ যুগে কান্টের কাছে বিমূর্ত সূত্রের চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অধিকতর মূল্যবান বলে বিবেচিত হত। এক্ষেত্রে কান্টের উপর অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাবকে আমরা লক্ষ করতে পারি। ১৭৭০ সাল থেকে কান্টের দর্শনে বিচারবাদী যুগের শুরু। তাঁর ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ বা ‘বিশুদ্ধযুক্তির সম্যক বিচার’ এর প্রকাশ ঘটে ১৭৮১ সালে এবং ‘ক্রিটিক অব প্র্যাকটিক্যাল রিজন’ ‘বাস্তবযুক্তির সম্যক বিচার’ এর প্রকাশ ঘটে ১৭৮৮ সালে।[৩]

এই সমস্ত গ্রন্থে কান্ট জ্ঞান, নীতি এবং নন্দনতত্ত্বের পর্যালোচনামূলক ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন। এ যুগে কান্টের প্রতিপাদ্য ছিল জ্ঞানের প্রকার এবং মানুষের জ্ঞান শক্তির সীমারেখার পূর্ব আলোচনা ব্যতীত আমাদের পক্ষে কোনো দার্শনিক তত্ত্ব স্থির করা আদৌ সম্ভব নয়। জ্ঞানের সীমা এবং প্রকারের পর্যালোচনার মাধ্যমে কান্ট অজ্ঞেয়বাদের সঙ্কটে সমুপস্থিত হন। তাঁর প্রত্যয় ঘটে যে, বস্তু যেমন আছে, তাকে তেমনভাবে জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। জ্ঞানের কতকগুলি সূত্রের মাধ্যমেই মাত্র মানুষ বস্তুকে জানতে পারে। সূত্রের মাধ্যম না থাকলে মানুষ বস্তুকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারত। কিন্তু বস্তুর তেমন প্রত্যক্ষ জ্ঞান মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বস্তুকে মানুষ বস্তুত্বের সূত্র, সময়কে সময়রূপ সূত্র দ্বারাই জানতে পারে। জ্ঞানের সূত্রগুলি মানুষ অভিজ্ঞতা-পূর্বরূপে লাভ করে। কিন্তু সূত্রই সত্তা নয়। ‘সময়’রূপ সূত্রের মাধ্যমে আমরা সময়কে জানি। তার মানে এই নয় যে, ‘সময়’রূপ সূত্রই সময়। বস্তু সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের ক্যাটেগরি বা সূত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাজেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা বস্তু বা সত্তাকে জানি না, সত্তার সূত্রমাধ্যম প্রকাশকেই জানি।[৩]

নীতিশাস্ত্রে কান্ট ‘ক্যাটেগরিকাল ইমপারেটিভ’ বা ‘শর্তহীন নিয়ামক’ এর বিধান তৈরি করেন। আচরণের ক্ষেত্রে শর্তহীন নিয়ামকের ব্যাখ্যা দিয়ে কান্ট বলেন, মানুষের আচরণের ন্যায়-অন্যায় কিংবা ভালোমন্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানুষের আচরণের ফলাফল কোনো বিবেচনার বিষয় হবে না। বিষয় নিরপেক্ষভাবে আচরণের ন্যায়-অন্যায় নির্দিষ্ট হবে। পিতা সন্তানকে পালন করবে সন্তানের কাছ থেকে ভবিষ্যতে প্রতিদান পাবার আশায় নয়, সন্তানের প্রতি স্নেহের আকর্ষণে নয়-তাকে পালন করা তার কর্তব্য বলে সে পালন করবে। নন্দতত্ত্বেও কান্ট বিষয়নির্বিশেষে এক আনন্দের কল্পনা করেন। কান্টের দর্শনে পরস্পরবিরোধিতা এবং অবাস্তবতার সাক্ষাৎ মেলে। সামাজিক বিকাশের প্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে কান্টের দর্শনের এই দুর্বলতার মূলে ছিল অষ্টাদশ শতকের জার্মান পুঁজিবাদী শ্রেণীর অগ্রসরতা এবং দুর্বলতা।[৩]

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কান্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানের নীহারিকা তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। তিনি মনে করতেন যে, যে জ্যোতির্মন্ডলে আমাদের বাস তার বাইরেও সংখ্যাহীন জ্যোতির্মন্ডলের মহাবিশ্ব বিরাজ করছে। পৃথিবী গ্রহের আবর্তনে জোয়ার ভাটার বিপরীত প্রভাব এবং গতি স্থিতির আপেক্ষিকতার তত্ত্বকেও কান্ট প্রতিষ্ঠিত করেন। হেগেল ও মার্কস এর দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের বিকাশে কান্টের এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অবদান অনস্বীকার্য।[৩]

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ৪ জানুয়ারি, ২০১৯, “ইমানুয়েল কান্ট ছিলেন অষ্টাদশ শতকের জার্মান ভাববাদী দার্শনিক ও বিজ্ঞানী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/immanuel-kant/
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৫০-২৫১।

1 thought on “ইমানুয়েল কান্ট ছিলেন অষ্টাদশ শতকের জার্মান ভাববাদী দার্শনিক ও বিজ্ঞানী”

  1. আমি নিয়মিত দর্শনের পাঠক । আপনাদের সাথে আছি । ধন্যবাদ

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!