ইলা সেন ছোটবেলা থেকে বাবার চাকরিসূত্রে দেশের বাইরে ছিলো। তারপরও পরাধীনর শেকলে বাঁধা শাসনব্যবস্থা ভাঙতে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তিনি কলেজে পড়তে এসে দেখেন ভারতে জাতীয় আন্দোলনের খরস্রোত তীরবেগে বয়ে চলেছে। তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দূরে রেখে শুধু লক্ষ্য করে যাবেন সে-মেয়ে ইলা ছিলেন না। আন্দোলনের স্রোতের মধ্যে নিজেকে বিপন্ন করেও, লাফিয়ে পড়ে তবে তিনি সার্থক বোধ করেছিলেন। পাশ্চাত্য আবহাওয়ায় বর্ধিত ইলা সেনের ভিতর থেকে ফুটে উঠেছিল স্বদেশপ্রেমিক, দুঃসাহসী ও অসামান্য এক ভারতীয় নারী।
জন্ম ও পরিবার
১৯০৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইলা সেন জন্মগ্রহন করেছিলেন মালয় ফেডারেটেড স্টেটস। পৈতৃক দেশ ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মধ্যে সোনারং গ্রামে। তার পিতা ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ সেন ও মাতা সুরবালা সেন। পিতা মালয় ফেডারেটেড স্টেটস-এর ডাক্তার ছিলেন এবং সেখানেই তাঁরা বসবাস করতেন। পিতামাতা ছিলেন উদারমতাবলম্বী ও শিক্ষানুরাগী। ১৯৩৭ সালে গৌহাটির নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সঙ্গে ইলা সেনের বিবাহ হয়। প্রখ্যাত বিপ্লবী ও সংবাদপত্রসেবী মাখনলাল সেন তার পিতার খুড়তুতো ভাই।
শিক্ষাজীবন
শিশুকাল থেকেই ইলা সেনের পড়াশুনা শুরু করেন। মালয়ের রোমান ক্যাথলিক নেভেস্ট স্কুল থেকে শিক্ষাজীবন শুরু। অনার্সসহ সিনিয়ার কেজি পাস করেন তিনি ১৯২৩ সালে। ১৯২৫ সালে কলিকাতায় এসে ডায়োসেসান কলেজ থেকে তিনি আই, এ, পাস করেন এবং ১৯২৭ সালে বেথুন কলেজে বি, এ, ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৯৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলনের শোভাযাত্রায় তিনি যোগদান করেন। ১৯৩৯ ও ১৯৩৩ সালে তিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এম.এ, এবং বি.টি, পাস করেন।
ইলা সেন ফেডারেটে মালয় স্টেস্-এ রোমান ক্যাথলিক কনভেন্ট স্কুলে সম্পূর্ণ ইংরেজী আবহাওয়ায় শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত করে তারুণ্যে পরিণত হয়েছিলেন এবং পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হয়েই লালিত পালিত হয়েছিলেন। তারপর যখন তিনি কলেজে পড়তে ভারতবর্ষে চলে আসেন।
রাজনৈতিক কাজ
১৯২৯ সালে তিনি কল্যাণী দাসের ছাত্রীসংঘের সভ্য হন এবং তখন থেকেই তিনি স্বাধীনতা-আন্দোলনে যুক্ত হন। স্বাধীনতা দিবস পালন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, রাজনৈতিক সভা ও শোভাযাত্রা প্রভৃতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৩০ সালে তিনি নারী সত্যাগ্রহ সমিতির পক্ষ থেকে বড়বাজারে বিলিতী কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করতে যেতেন এবং অর্ডিনান্সের বিরোধিতা করে সভা ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন। এই সময়কার একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সত্যাগ্রহ-আন্দোলনের সময় সভা ও শোভাযাত্রা বে-আইনী ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৩০ সালের ২২ জুন দেশবন্ধুর শ্রাদ্ধ তিথি বার্ষিকীতে সত্যাগ্রহীরা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। কলেজ স্কোয়র থেকে মেয়েদের শোভাযাত্রা দেশবন্ধু পার্কের দিকে অগ্রসর হয়। পুরুষ সত্যাগ্রহীরা দু-চারজন করে বিচ্ছিন্নভাবে আগেই গিয়ে কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের নিকট অবস্থান করেন। নারী সত্যাগ্রহীদের পিছনে অশ্বারোহী পুলিস ও পদাতিক পুলিস অগ্রসর হতে থাকে।
ইলা সেন অশ্বারোহী পুলিসের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যাগ্রহীদের উপর আক্রমণ যথাসাধ্য রোধ করবার ইচ্ছা নিয়ে সতর্কভাবে চলতে থাকেন। শোভাযাত্রা হ্যারিসন মোড় (মহাত্মা গান্ধী রোড) অতিক্রম করবার পর পুরুষ সত্যাগ্রহীরা মহিলাদের সম্মুখভাগে শোভাযাত্রা গঠন করেন। পুলিস-অফিসার পুরুষ সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠি চার্জ করতে পাঠান-অশ্বারোহী-পুলিসকে হুকুম দেয়। পাঠান-অশ্বারোহী-পুলিস নারী সত্যাগ্রহীদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই ইলা সেন সেই ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রতিরোধ করলেন এবং অগ্রসর হতে বাধা দিলেন। এইভাবে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাটায় যখনই কোনো অশ্বরোহী পুলিস তার সামনে দিয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেছিল তখনই তিনি বাধা দিয়ে প্রতিরোধ করতে থাকেন। অন্যান্য অনেক মহিলাও অনুররূপভাবে বাধা দিতে থাকেন। শোভাযাত্রা দেশবন্ধু পার্কে পৌছবার পর সভার অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। পুলিস লাঠি চার্জ করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এক-এক স্থানে দাঁড়িয়ে যায়। যে ইওরোপীয়ান অশ্বারোহী অফিসারটি লাঠিচার্জের হুকুম দেবার জন্য অগ্রসর হতে থাকে ইলা সেন তাকে বাধা দেবার জন্য দৃঢ়মুষ্টিতে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে ফেলেন। ঘোড়াটা লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু তবুও ইলা সেনের বদ্ধ মুষ্টি শিথিল হয় নি।
ঘোড়া লাফিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও ঘোড়ার লাগাম ধরা অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে থাকেন এবং ঘোড়া নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও নেমে আসেন। এইভাবে কিছুক্ষণ ঘোড়ার সঙ্গে ইলা সেনের ওঠানামা চলতে থাকে। তার এই দুঃসাহসিক কাণ্ড দেখে পুলিস ও সত্যাগ্রহী উভয় পক্ষই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। একটি ক্ষীণাঙ্গী নারীর অভূতপূর্ব সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তা সেদিন অনেক সত্যাগ্রহীর মাথা বাঁচিয়েছিল।
ওদিকে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সৈন্যদের যোগদান করতে আবেদন জানিয়ে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা ইস্তাহার প্রচার করছিলেন। ফলে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু হয়। ইলা সেন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মামলায় সাক্ষ্য দেবার জন্য কোর্ট ইলা সেনকে আহ্বান করে। কিন্তু তিনি কোর্টে শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ইংরেজের আইন আদালত তিনি মানেন না। এই আদালত অবমাননার দায়ে। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের হয়। এই পরোয়ানা জারী করার পূর্বেই তাকে পিকেটিং-এর দায়ে গ্রেপ্তার করে চারমাসের সাজা দেওয়া হয়।
১৯৩০ সালে জেলে সতীন সেন প্রভৃতি রাজনৈতিক বন্দীদের উপর পুলিস কমিশনার টেগার্টের প্রহারের প্রতিবাদে তিনি জেলে অনশন অবলম্বন করেন।
১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সে যোগদান করে তিনি দক্ষিণ কলিকাতা শাখার ভার গ্রহণ করেন। এবং ১৯৪৮ সালে তিনি দিল্লী যাওয়া পর্যন্ত ঐ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ইতিমধ্যে ১৯৪৬ সালে কলিকাতা দাঙ্গার সময় দালাপীড়িতদের উদ্ধার ও সাহায্যকার্যে তিনি বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি নানা সেবা ও গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র:
১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৯। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।
আচ্ছা, এই ইলা সেন কি Darkening Days বইটির লেখিকা?