হোমার (নবম বা অষ্টম খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্থিত?, আইওনিয়া? [এখন তুরস্কে]) ইলিয়াড এবং ওডিসি নামক পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি মহাকাব্যের অনুমিত লেখক। এই মহাকাব্য দুটি প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্মীকি ব্যাসদেব যেমন প্রাচীন কবি বলে স্বীকৃত তেমনি হোমারকেও বলা হয় ইউরোপের প্রাচীন ও আদি কবি।
হোমার জন্মেছিলেন গ্রীসে। তার জন্মস্থান বা জন্মকাল সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা যায় না। অনেকে এখনও বলে থাকেন যে হোমার নামে কোনো কবি ছিলেন না। কিন্তু এই মত পন্ডিত-গবেষক মহলে গৃহীত হয়নি।
অনুমান করা হয়, হোমার খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। কিন্তু তার জম্মস্থান বিষয়ে মতভেদ দূর হয়নি। গ্রীসের বিভিন্ন শহর হোমারের জন্মস্থান বলে দাবি করে থাকে।
জন্মসাল বা জন্মস্থান বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও যতদূর জানা যায়, তার মায়ের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। হোমারের মায়ের নাম ছিল মিলানোপাসা। পিতৃপরিচয় বিষয়ে কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
প্রাচীন গ্রীসের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অল্পবয়সেই হোমারকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য গুরুগৃহে বাস করতে হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, ফিলিয়াস নামে কোন এক শিক্ষকের পোষ্যপুত্ররূপে তিনি লালিত পালিত হন। গুরুগৃহে শিক্ষালাভের পর হোমার শিক্ষকতাকে জীবিকারূপে গ্রহণ করেন।
সেই সময় গ্রীসে লোকের মুখে মুখে ফিরত ট্রয় যুদ্ধের বিভিন্ন পৌরাণিক গল্প কাহিনী। চারণগণ গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই সব কাহিনী লোকজনকে গান গেয়ে বা আবৃত্তি করে শোনাত। হোমার এই প্রচলিত উপাখ্যানগুলির লিখিতরূপ দেন। এই হলো মহাকাব্য ইলিয়াড রচনার গোড়ার কথা।
আমাদের দেশের রামায়ণ সম্পর্কেও এমনি মতবাদ প্রচলিত। লোকের মুখে মুখে রাম চরিত্রের বিভিন্ন ঘটনা আবৃত্তি হত। বাল্মীকি সেগুলোকে লিখিত রূপ দেন। যাই হোক, বিয়োগান্তক মহাকাব্য ইলিয়াডের মূল কাহিনী এরকমঃ
ট্রয়ের রাজা ছিলেন প্রায়াম। তার পুত্র প্যারিস একবার পার্শ্ববর্তী রাজ্য স্পার্টায় যান। সেখানে তিনি রাজা মেনিলিউসের স্ত্রী সুন্দরী হেলেনকে দেখে মুগ্ধ হন ও পরে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে আসেন। এই ঘটনার পর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে এবং হেলেনকে উদ্ধার করবার জন্য গ্রীকরা তৎপর হয়।
আর্গসের রাজা মেনিলিয়াসের ভাই অ্যাগামেমননের গ্রীক বাহিনী ট্রয় আক্রমণ করে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে ট্রোজান ও গ্রীক বাহিনীর যুদ্ধ চলে। গ্রীকরা ট্রয় অবরোধ করে রাখে। সবশেষে গ্রীক বীর একিলিস মহাবীর হেক্টরকে বধ করেন। কাহিনীতে দেখা যায় দেবতারাও দুপক্ষে অংশ গ্রহণ করেছেন।
ইথাকার রাজা ওডিসিউস, যিনি ইউলিসিস নামেও পরিচিত, ট্রয় যুদ্ধের পরে সদলবলে দেশে রওনা হন। তার প্রত্যাবর্তন পথের ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে রচিত হয় ওডিসি মহাকাব্যের কাহিনী।
দুটি মহাকাব্যেই চব্বিশটি করে সর্গ বা অধ্যায় আছে। পন্ডিতদের মধ্যে মহাকাব্য দুটি নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে দুজন ভিন্ন ব্যক্তি কাব্য দুটি রচনা করেন। তবে আধুনিককালে স্বীকৃত হয়েছে যে মহাকাব্য দুটি একই ব্যক্তির রচনা। সেই ব্যক্তি হলেন মহাকবি হোমার।
জানা যায় যে হোমার মধ্য বয়সে দৃষ্টিক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে পুনরায় দৃষ্টিক্ষমতা ফিরে পান। এই মতও প্রচলিত যে হোমার ছিলেন জন্মান্ধ। মুখে মুখে তিনি মহাকাব্য দুটি রচনা করেছিলেন। জীবনী সম্পর্কে উক্তি প্রত্যুক্তি যাই থাক না কেন মহাকাব্য দুটির বিষয়বস্তু ও চরিত্র বর্ণনায় আনন্দানুভূতি ও সৌন্দর্যের যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন হোমার তার জন্যই তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন।
হোমার তার মহাকাব্যে গ্রীক বীরদের হাতে ট্রয় নগর ধ্বংস হওয়ার কথা লেখেন। আধুনিক কালে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের উৎখননের ফলে বিধ্বস্ত ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষ মহাকাব্য কাহিনীর সত্যতা বা বাস্তবতা নির্ণয় করে।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৯৮-১০০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।