হেনরিক যোহান ইবসেন ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নরওয়েজীয় নাট্যকার

হেনরিক যোহান ইবসেন (ইংরেজি: Henrik Johan Ibsen; ২০ মার্চ, ১৮২৮ – ২৩ মে, ১৯০৬) ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নরওয়েজীয় নাট্যকার। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ ইবসেনের নাটক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন যে তিনটে বিপ্লব, দুটো ক্রুসেড, কয়েকটা বৈদেশিক আক্রমণ ও একটা ভূমিকম্পের যতটা প্রভাব হওয়া উচিত ইংলন্ডে ইবসেনের নাটকের প্রভাব ঠিক ততটাই।

ইবসেনের প্রথম নাটক কাতিলিনা রচিত হয়েছিল সমালোচিত রোমান সেনাপতির নামে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় তার খ্যাম্পেহাইয়েন, নুরমা, সাকথান্স, নাত্তেন, ইয়লদ্যা প সুনহাইগ ও ফ্রু ইনগের তিল ওসল্লোত নামের নাটকগুলো।

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ তিনি বিদ্রুপাত্মক খ্যার্লিহেভেন্স কুমেদিয়ে এবং ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বের মিশ্রণে খঙ্গসেমনেনা নাটক লেখেন। ১৮৬৬ ও ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে লেখেন ব্রানদ ও পীয়েরয়িনত নাটক। এই দুটো নাটক লেখা হয়েছিল তার বিদেশবাসের সময়। এই সময় পর্যন্ত রচিত নাটকগুলির মধ্যে দেশের অতীত গৌরবের ইতিহাস বা সমাজসংস্কৃতি সম্পর্কে ইবসেনের চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে।

১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রচিত হয় ফররুল, এন ফোলকেফিনদে প্রভৃতি যে নাটকগুলো তার মধ্যে সমাজ ও সমাজের সমস্যা বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত হয়েছে।

ইবসেন ছিলেন এক অবিচল সংগ্রামী মনোভাবের মানুষ। তার নাটকে এই মনোভাবের রূপায়ন ঘটেছে প্রধানতঃ নারী চরিত্রের মাধ্যমে। তার এই প্রতিবাদী চরিত্র চিত্রনের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় ইবসেন সমাজ সংস্কারক হিসেবেই সমধিক পরিচিতি লাভ করেছেন।

নাট্য রচনার নবধারার প্রবর্তক এবং জাতীয়তাবাদী ইবসেনের জন্ম হয় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে মার্চ নরওয়ের স্কিয়েন শহরে। তার বাবা ক্লদ হেনরিক ইবসেন ছিলেন জাহাজের ব্যবসায়ী। মায়ের নাম মারিয়া কর্নেলিয়া অলতেনবার্গ। এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মেও জীবনের প্রায় চল্লিশটি বছর ইবসেনের কেটেছে কঠোর দুঃখ দারিদ্র্য আর জীবনসংগ্রামের মধ্যে। গোড়ার দিকে তার রচনারও কদর ছিল না।

বাবার অমিতব্যয়িতার ফলে ছেলেবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল ইবসেনের দুঃখের জীবন। পড়াশোনার কথা ভুলে তাকে বাধ্য হয়ে স্কীয়েনের বাইরে এক খামারে কাজ নিতে হয়েছিল। পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ার এই হয়েছিল পরিণতি।

বাল্য বয়স থেকেই খেলনা থিয়েটার নিয়ে মগ্ন থাকতে ভালবাসতেন। ফলে নাটকের প্রতি একটা স্বাভাবিক টান তার মধ্যে সব অবস্থাতেই বজায় ছিল। তাই ক্লেশকর জীবনের চারপাশের মানুষজন ও তাদের ঘিরে যে জীবন তার ঘটনার নাটকীয়তা সহজেই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করত। 

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে পঞ্চাশ মাইল দূরে গ্রীনস্ট্যান্ড শহরে একটা ওষুধের দোকানে শিক্ষানবিশের কাজ নেন। গ্রীনস্ট্যান্ডের জীবন খুবই কঠিন ছিল। তবু এখানে খানিকটা হাঁপ ছাড়তে পারলেন ইবসেন কয়েকজন সাহিত্য রসিক বন্ধুকে পেয়ে। এই সময় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন। তার এইসব কবিতায় থাকত নগরজীবনের প্রতি শ্লেষাত্মক আক্রমণ। আর থাকত নিজের কৈশোরের নিঃসঙ্গতা, মৃত্যুভয় ও বেদনা।

১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে পদ্যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক লিখলেন ক্যাটেলিনা — রোমের পটভূমিকায়। এবারে ইচ্ছা হলো নাটকটি ছাপাবার। কিন্তু চেষ্টা করেও প্রকাশক পেলেন না। শেষ পর্যন্ত এক বন্ধু ওলি স্কুলারুড এগিয়ে এলেন। তারই আর্থিক সাহায্যে ক্যাটেলিনা ছাপা হলো এবং সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করল।

দ্বিতীয় নাটক দ্য ওয়ারিয়রস টোম্ব প্রকাশের এক বছর পরে ইবসেন বারগেনের ওলি বুল থিয়েটারে একটা কাজের সুযোগ পেলেন। হলেন থিয়েটার ডিরেকটর। কিন্তু আবাল্যের লাজুক প্রকৃতি আর স্বভাবজাত ভীরুতার ফলে ডিরেকটর হিসেবে তিনি সফল হতে পারলেন না। অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সময় ঘাবড়ে যেতেন। ফলে বেশি দিন এই কাজে টিকতে পারলেন না।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইবসেন ডাক পেলেন অসলোর ন্যাশনাল থিয়েটারে। নরওয়ের নাট্যকলার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এই নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইবসেনও ত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। উৎসাহের সঙ্গে তিনি কাজে যোগ দিলেন।

ইবসেন ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী। বহু শতাব্দী ধরে নরওয়ে ছিল সুইডেনের অধীন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনার সন্ধির পরে ডেনিস অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নরওয়ে সুইডেনের রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জাতীয়তাবাদী তরুণদের সংগ্রাম চলতে লাগল ধীরে ধীরে। এই সঙ্গে শুরু হয়েছিল ভাষা চর্চার উন্নতির আন্দোলন।

ইরসেন এই আন্দোলনে যুক্ত হলেন। এই সময়েই তিনি স্বাধীন নরওয়ের ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচনা করলেন তার শ্রেষ্ঠ নাটক কিং মেকিং। কিছু রাজনৈতিক কবিতাও তিনি লিখেছেন এই সময়কালে।

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক অনটন সত্ত্বেও বিয়ে করলেন সুসান্না হারসনকে। অর্থের প্রয়োজন জরুরী হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে তাকে থিয়েটারের কাজ ছাড়তে হল ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে।

কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে কিছু সরকারী সাহায্য ইবসেনের নামে বরাদ্দ হলো। তবে এই সুবিধাও বেশি দিন কপালে সইল না। লাভস কমেডি নাটক প্রকাশের পর খ্রিস্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের বিরূপতার ফলে তার সরকারী বৃত্তি বাতিল হয়ে গেল। লাভস কমেডি নাটকে ইবসেন প্রচলিত বিবাহ রীতির বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেছিলেন।

দেশে আর মন টিকছিল না। এক বন্ধুর চেষ্টায় ইবসেন বিদেশ ভ্রমণের একটি বৃত্তি নিয়ে কোপেনহেগেন চলে গেলেন। সেখানে তিনি প্রুসিয়া-ডেনিস যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। এখান থেকে তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন জোনে ভাগ্য বিড়ম্বিত ইবসেনের জীবনে এবারে অনুকূল পরিবর্তনের সূচনা হলো।

কিছুকাল স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অবশ্য কৃচ্ছতার মধ্যে কাটল। ব্রান্ড নাটকের প্রকাশের পর তার জীবনে স্বচ্ছলতা ফিরে এলো। সরকারী তরফ থেকেও কবিবৃত্তি মঞ্জুর হলো। ইবসেনের বয়স যখন আটত্রিশ সেই সময় এলো তার জীবনে সাফল্য। সাফল্য নিয়ে এলো পরিবর্তন। লেখায় এলো স্বকীয়তা। সাহিত্যকর্মই হয়ে উঠল প্রধান অবলম্বন।

ক্রমে ক্রমে ইউরোপের সাহিত্য জগতে ইবসেনের সাহিত্যকৃতি নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হলো। সাহিত্য সাধনার জন্যই ইবসেন ঘর সংসার সবকিছুর বন্ধনকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করার এই জীবন-সত্যই তিনি তার রচনায় বিভিন্নভাবে উচ্চারণ করেছেন।

১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ দশ বছর ইবসেন জার্মানীতে ছিলেন। এখানেই তিনি ছয় বছরের পরিশ্রমের শেষে সম্পূর্ণ করেন জুলিয়ান দ্য অপেস্টেন্ট। এইভাবে নাটকের ঐতিহাসিক পর্ব শেষ করে নতুন ধারার গদ্য নাটক রচনায় মনোনিবেশ করলেন। এই নাটকগুলো তাকে ইউরোপীয় নাট্যকারের প্রতিষ্ঠা এনে দিল। সারা ইউরোপে ইবসেনের সবচাইতে বেশি আলোচিত নাটক হলো ডলস হাউস।

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে রোমে ফিরে এলেন ইবসেন। সমালোচকরাও তখন তাঁর রচনার গুণগ্রাহী। সর্বত্রই সুখ্যাতি। তেষট্টি বছর বয়সে তিনি অসলো ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। শেষ বয়সের নাটকগুলিতে সমাজ বিষয়ে তার বক্তব্যের মাধ্যম হয়েছিল গল্প বা প্লটের বদলে প্রতীক। তার জীবনের শেষ নাটক হলো হোয়েন ইউ ডেড অ্যাওকেন। আটাত্তর বছর বয়সে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১২৭-১৩০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!