হেমচন্দ্র দাস কানুনগো বা অভিরাম (ইংরেজি: Hemchandra Kanungo; ১২ জুন, ১৮৭১ – ৮ এপ্রিল, ১৯৫১) ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের অগ্রদূত। তিনি আলিপুর বোমা মামলায় (১৯০৮-৯) অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তাকে আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেয়া হয়, কিন্তু ১৯২১ সালে মুক্তি পান। সম্ভবত তিনি প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী ছিলেন যিনি ভারত থেকে সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন।
বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস কানুনগো মেদিনীপুর জেলার রাধানগরে ১৮৭১ সালের ১২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ক্ষেত্রমোহন কানুনগো। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে হেমচন্দ্র প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর মেদিনীপুর কলেজে এফ.এ পড়বার সময় অভিভাবকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি কলকাতায় গিয়ে ক্যাম্বল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়নে আগ্রহ হারিয়ে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার শখ ও অভ্যাস ছিল তার। কিন্তু আর্ট স্কুলেও পড়া শেষ করার আগেই মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে অঙ্কন শিক্ষক ও কলেজে রসায়নের প্রদর্শকের চাকরি নেন। এক সময় শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে দিয়ে চিত্রাঙ্কনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ঐ সময় তিনি মেদিনীপুর জেলা বোর্ডে কিছুদিন চাকরি করেন।
১৯০২ সালের গোড়ার দিকে তিনি মেদিনীপুরের গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করেন এবং বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হন। মেদিনীপুরের গুপ্ত সংগঠন পরবর্তীকালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ পরিচালিত কলকাতার বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে হেমচন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সক্রিয়ভাবে তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে যান।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় কলকাতার বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশের শাসক ও পদস্থ কর্মচারীদের নিধনের সংকল্প গ্রহণ করে। ঐ সময় হেমচন্দ্র পূর্ববঙ্গ ও আসামের কুখ্যাত লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হেমচন্দ্র তখন উপলব্ধি করেন যে, উপযুক্ত সংগঠন ও সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া এ ধরনের প্রচেষ্টা সফল হবে না। তাই তিনি ইউরোপীয় গুপ্ত রাজনৈতিক দলের কাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের জন্য ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে পৈত্রিক সম্পত্তির একাংশ বিক্রির টাকায় ইউরোপে চলে যান।
প্যারিসে পৌঁছে কয়েকটি গুপ্ত রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে তার অর্থ নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন তিনি বিদেশে অবস্থানরত ভারতীয় বিপ্লবী শ্যামাজী কৃষ্ণবর্মার সহযোগিতায় লন্ডনে গিয়ে ‘ইন্ডিয়া হাউস’ নামে ভারতীয় ছাত্রদের আবাসে কাজ নেন। ঐ সময় তিনি গোপনে একটি ক্ষুদ্র রসায়নাগার খুলে বোমা প্রস্তুত বিষয়ে পরীক্ষা চালান। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ নজরে পড়ে যাওয়ায় পুনরায় তাঁকে প্যারিসে চলে যেতে হয়। সেখানে তিনি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী মাদাম ভিকাজি কামার সঙ্গে পরিচিত হয়ে বোমা প্রস্তুত প্রণালি শিখতে থাকেন। সেখান থেকে ইপ্সিত অভিজ্ঞতা অর্জন করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর কলকাতায় বারীন্দ্রকুমার ঘোষের বিপ্লবী দলের সঙ্গে জড়িত হয়ে বোমা প্রস্তুতের কাজে মনোনিবেশ করেন। এ সময় উল্লাসকর দত্তসহ বিপ্লবী দলের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটে।
উল্লাসকর দত্ত ইতিমধ্যেই বোমা তৈরির নানা কায়দা-কৌশল শিখে ফেলেছিলেন। হেমচন্দ্র দাসের তৈরি একটি বোমা চন্দননগরের ফরাসি মেয়রের উপর নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে মেয়র বেঁচে যায়। পুস্তকাকৃতির অপর একটি বোমা অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে পাঠানো হয়। কিন্তু পুস্তকটি না খোলায় কিংসফোর্ডও রক্ষা পেয়ে যায়। হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর দত্ত’র তৈরি অন্য একটি বোমা ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর দ্বারা নিক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু সে অভিযানও ব্যর্থ হয়ে যায়।
২ মে মুরারি পুকুর বাগানবাড়ি থেকে পুলিস অন্যান্যের সঙ্গে হেমচন্দ্র দাসকেও গ্রেফতার করে। বিচারে তার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। ১৯২১ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। এরপর তিনি প্রতিকৃতি আঁকার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কিছুদিন তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের র্যাডিকাল ডেমোক্রেটিক দলেও সমর্থক হিসেবে কাজ করেছেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি স্বগ্রাম মেদিনীপুরে কাটিয়েছেন। বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা গ্রন্থে তিনি তার বিপ্লবী জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
তথ্যসূত্র
১. জয়দুল হোসেন, অবিভক্ত বাংলার অসমাপ্ত বিপ্লব, গতিধারা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৯৯-৩০০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
এইসব বিপ্লবীরা আমাদের প্রেরণা।