হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন বা হ্যানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (ইংরেজি: Hans Christian Andersen, ২ এপ্রিল, ১৮০৫ – ৪ আগস্ট, ১৮৭৫) ছিলেন বিশ্বের শিশু ও কিশোর সাহিত্যে সব দেশের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। কেবলমাত্র রূপকথার গল্প লিখে বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছেন। তাব মত এমন অন্তরঙ্গ সরস ভঙ্গীতে সহজ ও সরল ভাষায় এত সুন্দর রূপকথার গল্প আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অনা কোন সাহিত্যিক লিখতে পারেননি। তাঁর গল্পগুলিতে পাওয়া যায় অসীম দরদ আর প্রাণের গভীর স্পর্শ।
অ্যান্ডারসনের রূপকথার নির্ভরযোগ্য অনুবাদ পৃথিবীতে কোনো ভাষাতেই সম্ভ হয়নি। এই ত্রুটি সত্ত্বেও তিনি পৃথিবীর সকল দেশের শিশু ও কিশোর হৃদয়ে একান্ত আপনার জন হয়ে রয়েছেন। তার রূপকথাগুলি বড়দের কাছেও সমান উপভোগ্য ও প্রিয়।
রূপকথার রূপকুশলী শিল্পী আন্ডারসনের নিজের জীবনও ছিল একটি বিস্ময়কর রূপকথা। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা এপ্রিল ডেনমার্কের অন্তর্গত ফুনিন দ্বীপের ছোট্ট শহরে ওডেন্সে হ্যান্সের জন্ম হয়। তার বাবা জুতা তৈরি করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
এই হতদরিদ্র মানুষটির একটি বিশেষ গুণ ছিল। তিনি চমৎকার গল্প বলতে পারতেন। আর তুচ্ছ জিনিস দিয়ে অপূর্ব সুন্দর পুতুল ও খেলনা বানাতে পারতেন। হ্যান্স শিশু বয়সে মুগ্ধ হয়ে বাবার মুখের গল্প শুনতেন আর পুতুল বানানো দেখতেন। তার বদ্ধ ঠাকুমাও খুব ভাল গল্প বলতে পারতেন।
দুষ্টুমি আর খেলাধুলা ভুলে তিনি ঠাকুমার কাছে বসে মজার মজার রূপকথা শুনতে ভালোবাসতেন। তার জীবনে ছেলেবেলায় শোনা এই গল্পগুলির প্রভাব হয়েছিল খুবই গভীর। সাহিত্যিক হওয়ার আগে পর্যন্ত বহুদিন তিনি কোপেনহেগেনে সম্ভ্রান্ত পরিবারে ছেলেমেয়েদের গল্প বলে দুবেলা অন্ন সংস্থান করেছেন।
হ্যান্সের চেহারা ছিল অত্যন্ত কুৎসিত। শরীর ছিল রোগা প্যাকাটির মত। কিন্তু চোখ দুটি ছিল মায়াময়। নিখিল বিশ্বের অব্যক্ত বেদনায় যেন সর্বদা করুণ ও আর্দ্র হয়ে থাকত।
ওডেন্স শহরে বোধ হয় তাঁরাই ছিলেন সবচেয়ে গরীব। মাত্র আট বছর বয়সে তার বাবার মৃত্যু হয়। সংসার অচল হয়ে পড়তে দেখে মা মেরী দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন। কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য তাকে প্রতিবেশীদের কাপড় কাচার কাজ করতে হতো। এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তিনি হ্যান্সকে ওডেন্সের একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন।
এ সময়ে হ্যান্সের বয়স বারো-তেরো। পড়াশোনার অবসরে অন্য ছেলেমেয়েরা যখন খেলাধুলা করত তখন হ্যান্স বাড়িতে বসে বাবার তৈরি কাগজের ও কাঠের পুতুলগুলিকে নায়ক-নায়িকা সাজিয়ে অভিনয় করে সময় কাটাতেন। কখনো নাটক লেখার চেষ্টা করতেন।
শহরে ভ্রাম্যমান থিয়েটার পার্টি এলে অথবা জিপসীদের দলের ঝলমলে পোশাক পরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখতেন। এই সময় থেকেই তার মনে ভবিষ্যৎ জীবনে অভিনেতা বা নাট্যকার হবার বাসনা দানা বাঁধতে শুরু করে। এই দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে যা কিছু টাকা সম্বল করে একদিন ঘর ছেড়ে পায়ে হেঁটে দুদিনের পথ পাড়ি দিয়ে রাজধানী কোপেনহেগেনে এসে উপস্থিত হন।
তাঁর মনে স্বপ্ন তিনি হবেন ডেনমার্কের শেকসপিয়র। দেশজোড়া অর্থ ও খ্যাতি একসঙ্গে লাভ করবেন। কোপেনহেগেনে সেই সময় রয়্যাল থিয়েটারের খুব নামডাক। মনে আশা নিয়ে হ্যান্স থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু হতাশ হলেন। তবু দমলেন না। তাকে অভিনেতা হতে হবে, নাটক লিখতে হবে।
আর একদিন দেখা করলেন রয়্যাল একাডেমির মিউজিক কনডাক্টর সিবনির সঙ্গে। সেখানেও কপালে জুটল প্রত্যাখ্যান। তার কুৎসিত চেহারা আর গান সকলের হাসির উদ্রেক করল। তবে দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ তাকে সামান্য অর্থ সাহায্য করল।
অভিনেতা হওয়ার আশা যখন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, এই সময়েই হ্যান্স কোপেনহেগেনের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের অভিনয় ও গান শোনাতে শুরু করলেন। ছেলেমেয়েরা তার গল্প, অভিনয় ও গান শুনে আনন্দ পেত। সেই সঙ্গে বয়স্করাও। পরিবর্তে এঁদের কাছ থেকে তিনি আর্থিক সাহায্য ও দুবেলা খাবার পেতেন।
এইভাবে একদিন তার অভিনয়ের খ্যাতি ডেনমার্কের রাজকুমারীর কানে গিয়ে পৌঁছল। ডাক এলো রাজপ্রাসাদ থেকে। রাজকুমারী হ্যান্সের আবৃত্তি অভিনয় ও গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরস্কার দিলেন। হ্যান্সের জীবনে এই প্রথম প্রতিভার স্বীকৃতি।
এই সময়ে সুযোগ পেলেই তিনি নাটক লিখে পত্রিকায় পাঠাতেন। কিন্তু প্রত্যেকটি নাটকই অমনোনীত হয়ে ফেরত আসত। অবশেষে একদিন তার ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের জয় হলো। অ্যাল ফসল নামে একটি সাময়িক পত্রিকায় তার একটি নাটক প্রকাশিত হলো। আনন্দে আত্মহারা হ্যান্স সেদিন উপলব্ধি করলেন চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই একদিন ডেনমার্কের শেকসপিয়র হওয়া যাবে।
জোনাস কলিন নামে একজন রাজ অমাত্য ছিলেন রয়্যাল থিয়েটারের ডিরেক্টর। আল ফসল পত্রিকা হাতে করে একদিন হ্যান্স গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলেন। নাটকটি অবশ্য মনোনীত হলো না। কিন্তু এই সাক্ষাৎকার হ্যান্সের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। জোনাস কলিনের সুপারিশে তার লেখাপড়া শেখার জন্য সরকারী বৃত্তির ব্যবস্থা হল।
হ্যান্স সাইমন মাইসলিং নামে এক ভদ্রলোকের স্কুলে ভর্তি হলেন। এখানে অনেক অবহেলা লাঞ্ছনা সয়েও তিনি স্কুলের দুটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এবারে ঠিক করলেন তিনি পুরোদমে নাটক ও কবিতা লিখতে শুরু করবেন!
রয়্যাল থিয়েটারেও তাঁর নাটক অভিনীত হলো। এবারে জোনাস কলিন রাজকোষ থেকে তার বিদেশ ভ্রমণের জন্য একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। হ্যান্স সেই টাকায় দুবছর ধরে সারা ইউরোপ বেড়িয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কোপেনহেগেনে ফিরে এলেন।
ইতালির পটভূমিকায় আত্মচরিতমূলক The Improviatoe নামক উপন্যাস লিখে তিনি রাতারাতি ডেনিস সাহিত্যের একজন দিকপাল লেখকরূপে স্বীকৃতি লাভ করলেন। এতদিন পরে বই বিক্রির টাকা হাতে পেয়ে তিনি অর্থচিন্তার হাত থেকে নিস্কৃতি পেলেন।
হ্যান্সের দ্বিতীয় উপন্যাস যখন প্রেসে ছাপা হচ্ছে, এই সময় তার কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়ল। অর্থের তাগিদেই তিনি ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য তাড়াতাড়ি কতগুলো রূপকথা লিখে ফেললেন! বই আকারে লেখাগুলো প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সারা ইউরোপে সাড়া পড়ে গেল। রূপকথার গল্পগুলো হয়ে উঠল সবচেয়ে জনপ্রিয়। আজ লোক তার কবিতা, নাটক, উপন্যাসের কথা ভুলে গেছে।কিন্তু অমর হয়ে আছে রূপকথাগুলোই।
অ্যান্ডারসন জীবনে একদিকে চরমতম দুঃখ অপরদিকে প্রভূত সম্মান লাভ করেছেন। এমন ঘটনা কদাচিৎ দেখা যায়। জীবদ্দশায় তার মত সম্মান ইউরোপের আর কোনো সাহিত্যিকের ভাগ্যে জুটেছে কিনা সন্দেহ। চার্লস ডিকেন্স, ভিক্টর হুগো, আলেকজান্ডার দ্যুমা, ইনজম্যান প্রভৃতি দেশবিদেশের মনীষী তার বন্ধু ছিলেন।
হ্যান্স অ্যান্ডারসন ছিলেন অকৃতদার। যৌবনে এক সহপাঠীর বোনকে ভালবেসেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর লেখা রূপকথাগুলি পড়লে দেখা যায় প্রতিটি গল্পের মধ্যে অল্প-বিস্তর বেদনা মিশে আছে। এই বেদনার স্পর্শ গল্পগুলিকে আরও আবেগময়, সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
অ্যান্ডারসন রচিত দ্য লিটল মারমেড, স্লো কুইন, দ্য এম্পাররস নিউ ক্লোদস, দ্য পুওর লিটল ম্যাচ গার্ল, আগলি ডাকলিং প্রভৃতি গল্পের তুলনা পৃথিবীর কিশোর সাহিত্যে বিরল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা আগস্ট সত্তর বছর বয়সে রূপকথার যাদুকর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের মৃত্যু হয়।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: কোপেনগেহেনে একটি মোজাইকে ব্যবহৃত হ্যান্স অ্যাান্ডারসনের প্রতিকৃতি, আলোকচিত্র: Edelseider. ১ নভেম্বর ২০১৩।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১১২-১১৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।