হামিদুল হক ছিলেন বামপন্থী উদার গণতান্ত্রিক বিপ্লবী

কমরেড হামিদুল হক (৭ এপ্রিল ১৯৫২- ২ জুলাই ২০২৩) ছিলেন বামপন্থী উদার গণতান্ত্রিক বিপ্লবী এবং ১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের মহান সংগঠক। হামিদুল হক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ও ভারতে গমন করেন। সে সময় কলকাতায় বামপন্হী প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। হামিদুল হক ২০০৮-১০ সালের দিকে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নামে একটি বামপন্থী সংগঠন গড়ে তোলেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত থেকে কোনো অপারেশনের প্রাক্কালে ময়মনসিংহ শহরে আসার সময় কোনো এক আত্মীয় বাড়ী থেকে পাঞ্জাবী ও আলবদর বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে বন্দী হন। বন্দি অবস্থায় আলবদর ক্যাম্প থেকে আত্মরক্ষার্থে পলায়ন করে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে ভারতে চলে যান।

কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে জন্মগ্রহণকারী কমরেড হামিদুল হকের পিতা ছিলেন ডাঃ দছতুর আলী। হামিদুল হক তাড়াইল হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে আই, এ, এবং একই কলেজ থেকে ইতিহাসে ১৯৭২ সালে অনার্স সহ বিএ, এবং পরের বছর এমএ, ডিগ্রী লাভ করেন। বাল্যকাল থেকে রাজনীতির প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। কলেজে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালে অবিভক্ত ছাত্রলীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৬৬ সালে কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালে আইয়ুব শাসন বিরোধী গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক হন ও একই সঙ্গে কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সালে পুনরায় আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। সে সময় আদর্শগত কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং সিরাজ সিকদার পরিচালিত পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগদান করেন ও দলীয় স্বার্থে আত্মগোপন করেন। ১৯৭৪ সালে আত্মগোপন অবস্থায় গ্রেপ্তার হন ও বন্দী অবস্থায় কোতোয়ালী থানা থেকে পলায়ন করেন। ১৯৭৫ সালে আত্মগোপন থাকা অবস্থায় আবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আটক হন এবং আবার জেল থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকেন।

১৯৭৯ সালে আত্মগোপন অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৮২ সালে মুক্তি পান। মুক্তির পর বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে শহীদ বিপ্লবী দেশপ্রেমিক স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

হামিদুল হক ময়মনসিংহের বীক্ষণ পাঠচক্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৮৪ সালে আবার গ্রেপ্তার ও বিনা বিচারে আটক হন। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পেয়ে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক, স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা-ময়মনসিংহের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। তিনি ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে স্বদেশ চিন্তা সংঘের আলোচনায় মাঝে মাঝে অংশ নিতে যেতেন।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নামের সংগঠনে উনিই একমাত্র সভাপতি ও সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনে একজন সেক্রেটারি ছিলেন, সেই ছেলেকে দেখেছিলাম, সে ২০০৯ সালের দিকে খাগড়াছড়িতে পাহাড় কিনে ফেলেছে, আম বাগান করছে। পরে বাসদও পাহাড় কেনে।

বামপন্থীরা ঐক্য ঐক্য খেলা খেলতে পছন্দ করে। বাসদের টাউটেরা তলে তলে প্রচার করত, সম্ভবত নামের মিলের কারণে, হামিদ ভাই বাসদে যোগ দেবেন। বাস্তবে হামিদ ভাইয়ের সংগঠনে কোনো লোক কোনোদিনই ছিল না, ফলে অন্য কোনো সংগঠনে যোগ দেবার প্রশ্নও ছিল না।

কমরেড হামিদুল হক সম্পর্কে শুনুন অনুপ সাদির মূল্যায়ন

আমার ময়মনসিংহে অবস্থানকালীন সময়ে হামিদ ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে; উনার চর কালীবাড়ি বস্তি আন্দোলনে অবদানের কথা জানার পরে। বস্তির গরিব মানুষজনের খোঁজ রাখতেন, সহায়তা করতে বলেছেন, দু একজনকে দেখিয়েও দিয়েছেন। উনি ময়মনসিংহে এলে বক্তৃতা শুনতে গেছি। তিনি পনের বিশ মিনিট কোনো মতো বক্তৃতা দিতে পারতেন, এর চেয়ে বেশি সময় বক্তৃতা দিতে পারতেন না।তিনি পাঠচক্রের আলোচনা বা টেবিলের আলোচনাও করতে পারতেন না। স্বদেশ চিন্তা সংঘে দেখেছি, অন্য জনের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়তেন।

হামিদুল হক সাংগঠনিকভাবে অদক্ষ ছিলেন; পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি, কংগ্রেস, পলিট ব্যুরো ইত্যাদি বিষয় একটুও বুঝতেন না। মাঝে মাঝে আমাকে একটি প্রশ্ন নাড়া দেয়, এই যে পার্টি না বুঝেই, কোনো লোক না থেকেও পার্টি করা, এটা কেন কিছু বামপন্থী করে থাকেন? সেই প্রশ্নের এমন বাজে উত্তর মাথায় আসে তা প্রকাশ্যে না বলাই ভাল।

আরো পড়ুন

পেশাগতভাবে তিনি ঢাকাস্থ মহানন্দা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজেস লিঃ এর পরিচালকমন্ডলীর সদস্য ও পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি ২ জুলাই ২০২৩ তারিখে ঢাকার একটি হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!