লর্ড জর্জ গর্ডন বায়রন ছিলেন ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি

লর্ড জর্জ গর্ডন বায়রন (ইংরেজি: George Gordon Byron; ২২ জানুয়ারি ১৭৮৮ – ১৯ এপ্রিল ১৮২৪) ছিলেন ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কবি প্রতিভা তাঁকে করে তুলেছিল ইউরোপ মহাদেশের এক সময়ের বহু আলোচিত রোমান্টিক নায়ক। লন্ডনের অভিজাত সম্প্রদায়ের যুবকেরা ও মেয়েরা তাঁকে অনুকরণ করতে আরম্ভ করেছিলেন এমনকি পোশাকে পরিচ্ছদেও। 

বায়রন-অঙ্কিত চরিত্রের অনুকরণে তাঁরা বিষাদগ্রস্ত রোমান্টিক নায়কদের মত আচরণ করতে … … অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এই অনুকরণপ্রিয়তা সারা ইউরোপে, বিশেষত জার্মানীতে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। জার্মানীতে বায়রনের স্থান শেকসপিয়রের পরেই।

১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি লর্ড বায়রনের জন্ম। জন্মসূত্রে তিনি দুটি অভিজাত পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বাবা জন বায়রন ছিলেন ইংরেজ। মা ক্যাথারিন গর্ডন ছিলেন অভিজাত স্কটিশ মহিলা। বায়রনের চরিত্রে ফুটে উঠেছিল একই সঙ্গে উদ্দামতা ও বন্যতা এবং উদারতা ও স্নেহশীলতা। বাবা ও মা বিপরীত স্বভাবের এই দুজনের সংমিশ্রণেই গড়ে উঠেছিলেন বায়রন।

জন্মের কিছুদিন পরেই বায়রনের পিতা জন বায়রন তাঁর মাকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন। স্বভাবের জন্য লোকে তাঁকে বলত ম্যাড জ্যাক। শিশুপুত্রকে নিয়ে ক্যাথারিনের জীবন সংগ্রাম আরম্ভ হয় অ্যাবার্ডিন শহরে। মিসেস ক্যাথারিন ছিলেন উদারচেতা ও স্নেহশীলা এবং একই সঙ্গে প্রচন্ড বদমেজাজী ও বদরাগী। তাঁর পুত্রের মধ্যেও এই স্বভাবের সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

জন্ম থেকেই বায়রন ছিলেন খঞ্জ। সম্ভবত শিশু পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়াতেই তাঁর একটি পা বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। বায়বন সারাজীবন ধরে তাই বিষন্নতার বোঝা বয়ে বেড়িয়েছেন। তাঁর এই বিষণ্ণতা তাঁর সাহিত্যেও ওতপ্রোত হয়েছিল।

পাঁচ বছর বয়সেই লেখাপড়া শুরু হয়েছিল বায়রনের। পড়তে শিখেই তিনি ইতিহাসের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। স্কুলে পড়ার সময় মুষ্টিযুদ্ধ ও সাঁতারেও খুব দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন বায়রন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ক্রিকেটও খেলেছেন।

ডালউইচ বিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন হারাতে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে। এখান থেকে বেরিয়ে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াকালীনই তাঁর উশৃঙ্খল জীবনযাত্রার শুরু হয়। তবে এক মুষ্টিযোদ্ধা বন্ধুর প্রভাবে শরীর চর্চা করে সুঠাম ও সুন্দর দেহের অধিকারী হয়েছিলেন।

কলেজে পড়ার আগেই বায়রনের কবিতা চর্চা শুরু হয়েছিল। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ Hours of Idleness প্রকাশিত হয়। বিশেষ উঁচু মানের না হলেও কাব্যগ্রন্থটি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এডিনবরা রিভিউ নামের পত্রিকায় বইটির বিরূপ সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এর ফলে বায়রন মনে আঘাত পেয়ে ইংরাজ সাহিত্যিকদের প্রতি ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। একবছর পরে তিনি লিখলেন English Birds and Scotch Reviewers. এবারের বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয়তা লাভ করল একমাসের মধ্যেই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

বেহিসেবী খরচ এবং উশৃঙ্খল স্বভাবের কারণে মায়ের সঙ্গে বায়রনের সম্পর্ক দিন দিনই খারাপ হয়ে পড়ছিল। এ সত্ত্বেও কবি তার স্বভাব শুধরাবার চেষ্টা করেননি। ঋণের পর ঋণ করে খেয়াল খুশি মত আনন্দ ফুর্তি করে টাকা ওড়াতেন। নিউ স্টেটের পৈতৃক বাড়িতে বসবাস কালেই ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে বায়রন তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন।

এই সময় তিনি গ্রিস, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ পরিভ্রমণ করেন। আলবানিয়া হয়ে গ্রীসে যাবার পথে বায়রন লিখতে শুরু করেন তার অমর সৃষ্টি Child Harold’s Pilgrimage. আলবানিয়ার বন্য সৌন্দর্য আর আধা সভ্য অধিবাসীদের দেখে খুবই আনন্দ পেয়েছিলেন বায়রন। তাঁর ভ্রমণ অভিযানের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছিল এই বইটিতে। গ্রীসের এথেন্সে তিন মাস বাস করেন বায়রন। ছেলেবেলা থেকেই ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। তাই গ্রীসের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি ও প্রাচীন কীর্তিগুলির ধ্বংসাবশেষ তাকে মোহিত করেছিল।

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বায়রন ইংলন্ডে ফিরে আসেন। এদিকে পাওনাদারদের অস্থিরতাও বেড়ে উঠেছিল। তিনি যখন ঋণের দায়ে ব্যতিব্যস্ত সেই সময়েই তার মা মারা যান। ডালমে নামে বায়রনের একজন সাহিত্যানুরাগীবন্ধু ছিলেন। বায়রন তাঁকে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণকালে রচিত চাইল্ড হ্যারল্ডের প্রথম দুটি সর্গ পড়তে দিয়েছিলেন। এই সূত্রেই আকস্মিকভাবে ভাগ্য বিপর্যস্ত বায়রনের জীবনে ঘটল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। তিনি রাতারাতি ইংলন্ডে নায়কের মর্যাদা লাভ করে বসলেন। ডালমে বন্ধুর কাব্যটি পড়ে এমনই মুগ্ধ হলেন যে তিনি এক প্রকাশককে দিলেন সেটি প্রকাশের জন্য।

প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরে পরেই বায়রন হাউস অব লর্ডসে যোগ দিয়েছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে তিনি নিউ স্টেটের পৈতৃক বাড়িতে জোরদার ভোজসভারও আয়োজন করেছিলেন। তিনি যেদিন হাউস অব লর্ডস-এ প্রথম ভাষণ দিলেন তার কয়েক দিন পরেই প্রকাশিত হল চাইল্ড হ্যারল্ড-এর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব।

হাউস অব কমন্স-এ মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে ভাষণ দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। চাইল্ড হ্যারল্ড তাকে রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিল। লন্ডন শহর যেন বইটি নিয়ে উন্মাদ হয়ে উঠল। নিজের এই অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বায়রন বলেছেনঃ একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। লন্ডনের অভিজাত সম্প্রদায় বায়রনকে সাদরে বরণ করে নিলেন। মেয়েরা তাঁকে দেখবার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। ভাগ্যের অবিশ্বাস্য প্রসন্নতার সঙ্গে সঙ্গে সকলের অলক্ষে এই সময়ে বিপর্যয়ের অঙ্কুরও রোপিত হলো।

নিঃসঙ্গ, সদা-বিষন্ন রহস্যময় রোম্যান্টিক তরুণ কবি অতি দ্রুত একাধিক প্রেমের ঘটনায় জড়িয়ে পড়লেন। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে এবং গৃহিণীরাই ছিলেন তাঁর প্রেমপাত্রী। এই সময়েই পরপর প্রকাশিত হলো তাঁর কাব্যগ্রন্থ The Giaur (১৮১৩ খ্রিঃ); The Bride of Abydas (১৮১৩ খ্রিঃ), The Carsair (১৮১৪খ্রিঃ), Lara (১৮১৪ খ্রিঃ)।

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বায়রন অ্যাসবেলা মিলবককে বিয়ে করেন। এই বিয়েই বায়রনের জীবনে দুঃসময় ডেকে আনল। বিয়ের এক বছর পরে বায়রন দম্পতির একটি কন্যা সন্তান জন্মাল। মেয়েটির নাম রাখা হয়েছিল অগাষ্টাস আভ। মেয়ের জন্মের পাঁচ সপ্তাহ পরেই লেডি বায়রন তাঁর স্বামীকে ছেড়ে চলে যান। বায়রনের বিবাহ বিচ্ছেদের সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে এই ব্যাপার নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। আর এই ক্ষোভ ছিল বায়রনের বিরুদ্ধে। খবরের কাগজগুলোতেও তাঁর বিরুদ্ধে লেখালেখি চলতে লাগল।

ফোঁড়ার ওপর শাকের আঁটির মত এই সময়ে বায়রনের আর্থিক দুরবস্থাও চরমে উঠেছিল। পাওনাদাররাও সমালোচকদের সঙ্গে সুর মিলাল। রাতারাতি যেমন একদিন তিনি দেশ জুড়ে বিখ্যাত হয়ে পড়েছিলেন তেমনি রাতারাতিই তিনি হয়ে উঠলেন সমাজের সকলের ঘৃণার পাত্র। ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে বায়রন চিরকালের জন্য দেশ ত্যাগ করলেন।

লন্ডন ছেড়ে জেনেভায় এসে বাস করতে লাগলেন বায়রন। এই সময়ে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে লিখলেন The Prisoner of Chillon। বেশ কিছু ছোট কবিতার সঙ্গে চাইল্ড হ্যারল্ড-এর শেষ পর্ব সমাপ্ত করলেন। এই সময়কালেই জেনেভায় বিখ্যাত কবি শেলির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে বায়রনের এবং অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। উত্তর ইতালি ঘুরে বায়রন এসে বাস করতে লাগলেন ভেনিসে। তখনো সমানে চলছিল তার অমিতব্যয়ী জীবনযাপন। তবে সৃজনশীলতা কখনো ব্যাহত হতে দেননি তিনি। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত Manfred সহ Don Juan-এর দুটি পর্বও এই সময়ে রচনা করেন বায়রন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো Cain। বইটি ইংলন্ডে খুবই আলোড়ন তুলল। ধর্মীয় মৌলবাদীরা বইটির নিন্দায় সরব হয়ে উঠল।

বায়রনের অমর সৃষ্টি Don Juan রচিত হয়েছিল ১৮১৯-১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে যখন গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। বায়রন গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করার সঙ্কল্প গ্রহণ করলেন এবং গ্রীসের সমর্থনে অস্ত্র ধারণ করলেন। যুদ্ধকালেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বৎসর বয়সে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল বায়রন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বায়রনের কবি প্রতিভা সমগ্র ইউরোপের সমসাময়িক সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বর্ণময় রচনাশৈলী এবং সমসাময়িক চিন্তাধারার প্রতি ব্যঙ্গাত্মক কটাক্ষই বায়রনকে সাফল্যের উচ্চতম শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।

নিজের জীবদ্দশায় অন্য কোনো কবির ভাগ্যেই এমন ঘটনা ঘটেনি। একটা বিষণ্ণতা বোধ বা কল্পিত দুঃখবোধ বায়রনের সারা জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাঁর প্রত্যেকটি রচনার মধ্যেই তাই একটি ভুরু কোঁচকানো ভাব ফুটে উঠেছে। এখানেই কবি বায়রনের বিশিষ্টতা। উল্কার মতই ছিল তাঁর আবির্ভাব। উল্কার মতোই ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের সর্বত্র। একদিন আবার উল্কার মতই আকস্মিকভাবে অন্তর্ধান ঘটেছিল তাঁর।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১৪২-১৪৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!