জর্জ বার্নাড শ ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার

শ বা জর্জ বার্নাড শ (George Bernard Shaw; ২৬ জুলাই ১৮৫৬ – ২ নভেম্বর ১৯৫০) হচ্ছেন উইলিয়াম শেক্সপীয়রের পরেই ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নাট্যকারের নাম। তিনি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জর্জ কার শ এবং মায়ের নাম এলিজাবেথ।

তাদের পরিবারের প্রায় সকলেই ছিলেন গানবাজনার ভক্ত। শ-এর মা এলিজাবেথও ছিলেন সুগায়িকা। মায়ের গান শুনতে শুনতে শ-এর ভাবুক মন অজানা এক স্বপ্নরাজ্যে চলে যেত। বর্তমানের গভীর বাইরে এমন এক কল্পলোকে তার মন বিচরণ করত, যেখানে মানুষ একান্তভাবেই ভগবানের কাছে আত্মসমর্পিত। সেখানে হানাহানি নেই, নেই মানুষে মানুষে বিদ্বেষ। সবকিছুতে, সর্বত্র বিরাজমান অনাবিল শান্তি।

ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুব একটা কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেননি বার্নাড শ। তবে তার অনুসন্ধিৎসা ছিল খুবই প্রবল। জ্ঞানপিপাসা মেটাবার জন্য পাঠাগারকেই করে নিয়েছিলেন একমাত্র বন্ধু। দশ বছর বয়স হবার আগেই তিনি বাইবেল এবং শেক্সপীয়রের রচনা পড়া শেষ করেছিলেন। ডাবলিনের ওয়েসলি কলেজে তিনি শিক্ষালাভ করেন এবং বাড়িতে বসেই সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পে কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে শ’ লন্ডনে চলে আসেন। সেই সময় তার সঙ্গে ছিল কিছু লেখা। কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি লেখালিখি শুরু করেছিলেন। ১৮৭৯-৮০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যে শ’ পাঁচখানি উপন্যাস রচনা করেন।

কিন্তু লন্ডনের প্রায় সবকটি প্রকাশন সংস্থাই তার লেখা প্রত্যাখ্যান করেছিল। দিনের পর দিন তিনি পাণ্ডুলিপি বগলে নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। প্রথম নয় বছর লন্ডন বাস কালে বই লিখে তিনি রোজগার করেন মাত্র নয় পাউন্ড।

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান অর্থনীতিবিদ হেনরি জর্জ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শ’ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এতদিন পর তিনি যেন আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে পেলেন। শ’ অন্যান্য সোশ্যালিস্টদের নিয়ে Fabian Society গঠন করলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একজন সুদক্ষ বক্তা এবং যুক্তিবাদী তার্কিক রূপে গতি লাভ করলেন। বড় বড় জনসভায় মোটা দক্ষিণার বিনিময়ে তিনি বক্তৃতা দিতে লাগলেন।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ’ G.B.S. — আদ্যক্ষরে সঙ্গীত ও নাটক সমালোচনা আরম্ভ করলেন। তার ঋজু এবং প্রগতিবাদী সমালোচনায় রক্ষণশীলদের বিরাগ উৎপাদন করলেও সাধারণ পাঠকদের প্রশংসা লাভ করল। তাঁর সমালোচনায় বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গকৌতুক এমনভাবে মিশে থাকত যে সংশ্লিষ্ট মহল সেই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত।

Corno di Bassetto ছদ্ম নামে শ শিল্প সমালোচনা করতেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর প্রভাবে লণ্ডনের সঙ্গীত, শিল্প ও নাট্যজগতের ধারা অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের হয়ে উঠেছিল। সমালোচনার কাজ করতে করতেই শ’ নিজে নাটক রচনায় হাত দিলেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম নাটক widowers Houses প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই রচনা দর্শক আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়।

তিনি অগত্যা তাঁর প্রথমদিকের নাটকগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে লাগলেন। এই নাটকগুচ্ছের মধ্যে আছে The Philanderer, Mrs. Warren’s Profession. ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় Plays Pleasant and Unpleasant, Arms and the Man, Candida এবং You Never can Tell. 

শেষোক্ত নাটকটি প্রকাশের পরই পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হলো। নাট্যকার রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন তিনি এবং নাটককেই নিজের ভাবপ্রকাশের বাহনরূপে বেছে নিলেন। শ তার প্রত্যেকটি নাটকে বিস্তৃত ভূমিকা রচনা করতেন। তাই লেখাগুলো ছিল অতিশয় উপভোগ্য।

নাট্যকার রূপে প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে সঙ্গে শ-এর জীবনে আর্থিক অনিশ্চয়তা দূর হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শার্লট পেইন টাউনসেন নামে সমাজবাদে বিশ্বাসী এক ধনী আইরিশ তরুণীকে বিয়ে করলেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই এই নাট্যাকার রচনা করলেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। এক ঐতিহাসিক বিষয়কে খুবই সহজ সরল ভাবে ব্যবহার করেছেন এই নাটকে। তাঁর নাটকগুলি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তাঁর নাটকের জন্য লন্ডনের নাট্য দলের ম্যানেজারদের মধ্যে রীতিমত কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। তার নাটকের বাণিজ্যিক সাফল্য হয়ে উঠেছিল এমনই।

ফেবিয়ান পন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে শ স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই সময়ে তিনি কাউন্সিলারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংলন্ডের ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে শ-এর বক্তব্য প্রথম দিকে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত সকলেই তার মতামত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

শ’ নিজে যা বিশ্বাস করতেন তা নির্ভীক বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্রকাশ করতেন। নীতিবাগিশদের ভণ্ডামিকে তিনি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করতেন। নিজস্ব নাটকের বিষয়বস্তুকে বিশ্বজনীনতার পর্যায়ে পৌছে দেবার বিরল ক্ষমতা ছিল শ-এর। যৌবনে ঔপন্যাসিক হিসেবে সাহিত্যজীবন শুরকরে পরে নাট্যকার, সমালোচক, সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি যশস্বী হন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে রচিত তার Back to Methuselah (১৯২১) এবং Saint Joan (১৯২৩) বিভিন্ন দিক থেকে খাঁটি নাটকের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে গৃহীত হয়। তাঁর অন্যান্য নাটকগুলির মধ্যে মেজর বারবারা, ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান, জন বুলস আদার আইল্যান্ড, দ্য ডক্টরস ডায়লামা, গেটিং মেরিড, ফ্যানিস ফাস্ট প্লে, পিগম্যালিওন, জেনেভা উল্লেখযোগ্য।

এসব নাটক ছাড়াও শ উত্তেজনামূলক বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেন – The Intelligent Womani’s Guide to Socialism and Capitalism, The Adventures of a Black Girl in Search of God প্রভৃতি।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় জর্জ বার্নাড শকে। মূলত সেন্ট জোয়ান গ্রন্থের জন্যই ছিল তার এই পুরস্কার। কিন্তু শ পুরস্কারের অর্থ নিতে রাজি হন না। সেই অর্থ সবটুকুই তিনি দান করেছেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটি তাকে ডক্টরেট এবং স্বয়ং রাজা তাকে নাইট উপাধি দিতে চান। কিন্তু এ সমস্তই তিনি সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করেন।

বার্নার্ড শ তার রচনায় প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরোধিতা করেছেন, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীব্র কশাঘাত চালিয়েছেন। এর ফলে তার সমসাময়িক কালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে বিতর্কিত পুরুষ। সারাজীবন ধরে তিনি যা সত্য বলে বুঝেছেন তাই প্রচার করেছেন। চুরানব্বই বছর বয়সে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা নভেম্বর বার্নাড শ’ পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১৩৪-১৩৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!