ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ মহান বিপ্লবী ও দার্শনিক

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বা ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস বা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বা এঙ্গেলস (ইংরেজি: Friedrich Engels, ২৮ নভেম্বর, ১৮২০ – ৫ আগস্ট ১৮৯৫) বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ মহান বিপ্লবী, জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী, লেখক ও দার্শনিক। তিনি কার্ল মার্কসের সঙ্গে একত্রে মার্কসবাদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। উনিশ শতকের এই দার্শনিক গত দেড়শ বছর ধরে মানব সমাজের অন্যতম একজন প্রভাবশালী দার্শনিক ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তক হিসেবে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন।[১]

আধুনিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কার্ল মার্কসের সঙ্গে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের নাম যুক্তভাবে উচ্চারিত হয়। চিন্তা, আদর্শ এবং সংগ্রামী আন্দোলনের ইতিহাসে যৌথ প্রয়াস এবং অবিচ্ছিন্ন সাথীত্বের এরূপ দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। এঙ্গেলস তাঁর সমস্ত গ্রন্থেই তিনি যে-কোনো যুগ বা ব্যক্তির দর্শনের শ্রেণি চরিত্র প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ব্যাখ্যা করে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, স্থুল বস্তুবাদ বা ইতিপূর্বেকার যান্ত্রিক বস্তুবাদের সাথে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পার্থক্য আছে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মনকে যেমন বস্তুর অতিরিক্ত স্বাধীন কোনো সত্তা বলে স্বীকার করে না, মনকে বস্তুর জটিল বিকাশের বিশেষ পর্যায় বলে বিচেচনা করে, তেমনি মনকে অস্বীকারও করে না। বস্তুর সঙ্গে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককে সে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে।

জার্মানিতে জন্ম হলেও এঙ্গেলস তাঁর সংগ্রামী জীবনের অধিকাংশকাল ইংল্যাণ্ডে অতিবাহিত করেন। ইংল্যাণ্ড আগমন করে কার্ল মার্কস-এর (১৮১৮-১৮৮৩) সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকে তাঁর আমরণ সংগ্রামী সাথীতে পরিণত হন। কার্ল মার্কস বিপ্লবী চিন্তা এবং আন্দোলনের জন্য জার্মানির তৎকালীন সামন্তবাদী সরকার কর্তৃক বহিষ্কৃত হয়ে ইংল্যাণ্ডে নির্বাসিতের জীবন যাপন করেছিলেন।

কিশোর বয়স থেকেই এঙ্গেলস চিন্তাধারায় বস্তুবাদী এবং সংগ্রামী অগ্রসর মানুষের পক্ষভুক্ত ছিলেন। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জার্মান দার্শনিক শেলিং-এর ভাববাদী দর্শনকে সমালোচনা করে একখানি বই লিখেন। ১৮৪৮-৪৯ খ্রিষ্টাব্দ জার্মানীতে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষক ও শিল্পের শ্রমিকদের বিপ্লবী আন্দোলনের কাল ছিল। এই বিপ্লবী আন্দোলনের পরাজয়ের পরে তিনি দেশ ত্যাগ করে ইংল্যাণ্ড গমন করেন। পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশে ইংল্যান্ড তখন শীর্ষস্থানে। ইংল্যাণ্ডের শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাস্তব জীবনের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা এঙ্গেলসকে পুঁজিবাদের মৌলিক বিরোধ সম্পর্কে নিঃসন্দেহরূপে প্রত্যয়ী করে তোলে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এঙ্গেলস ‘ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’ নামে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্কসের সঙ্গে যুক্তভাবে তিনি ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ রচনা করেন। ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ ছিল তখনকার সাম্যবাদী দলগুলোর ঘোষণাপত্র। কমিউনিস্ট ইশতেহার তখন থেকে কেবল বিপ্লবী দলের ঘোষণাপত্র নয়, মার্কসবাদী তত্ত্বের স্পষ্টতম এবং অতুলনীয় ঘোষণাসার হিসাবে পৃথিবীময় পরিচিতি আসছে। এঙ্গেলসের আর্থিক আনুকূল্য ব্যতীত মার্কসের পক্ষে ইংল্যাণ্ডে জীবন ধারণ করা এবং তাঁর সমাজতান্ত্রিক গবেষণা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ত।

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের জন্ম জার্মানির বার্মেন শহরে। একজন মিলমালিক হলেও যৌবনকাল থেকেই তিনি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। জীবনের বড় একটা সময় তাঁর ইংল্যান্ডে কাটে। ছাত্রাবস্থায় তরুণ হেগেলপন্থীদের বামপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। এই সময়ে হেগেলীয় রক্ষণশীলতা ও ফ্রিডরিখ হেগেলের ভাববাদী দর্শনের স্ববিরোধিতা সম্পর্কে এঙ্গেলস অনেক প্রবন্ধ লেখেন। পিতার নির্দেশে ইংল্যান্ডে বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি বিপ্লবী আদর্শে প্রভাবিত হন এবং শিল্পোন্নত দেশের শ্রমিক শ্রেণির সংস্পর্শে আসেন এবং ক্রমে একজন সমাজতন্ত্রী হয়ে পড়েন।[২]

এঙ্গেলস রচনাবলী

এঙ্গেলস-এর রচনাবলীতে বস্তু এবং গতি, সময় ও স্থানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, অজ্ঞেয়বাদের অসারতা, বস্তুর উপাদানের জটিল গঠন এবং তার উন্মোচিত অসীমতা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা এবং এ সব সমস্যায় তাঁর সুস্পষ্ট মার্কসবাদী অবদানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।[৩]

পুঁজিবাদী সমাজের বিশ্লেষণ ও সমালোচনার গ্রন্থরাজি হিসাবে মার্কসের ‘পুঁজি’ বা ‘ক্যাপিটাল’ সুবিখ্যাত। এ গ্রন্থসমূহের রচনাতে মার্কস এঙ্গেলসের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং বাস্তব সাহায্য লাভ করেন। মার্কসের মৃত্যুর পরে তাঁর ‘ক্যাপিটালের’ দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা কাজ এঙ্গেলস সমাধা করেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা, ‘এ্যান্টি ডুরিং’, ‘লুডুউইগ ফয়েরবাখ’, ‘পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ প্রভৃতি গ্রন্থ এঙ্গেলস-এর মনীষার উদাহরণ।

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ছেড়ে প্যারিসে আসার পর তাঁর সঙ্গে মার্কসের পরিচয় ঘটে। পরবর্তী বছর দুয়েকের মধ্যে প্রকাশিত ‘দ্য হোলি ফ্যামিলি’ এবং ‘জামান ভাবাদর্শ’ বই দুটির যুগ্ম-লেখক ছিলেন দুজনে। জার্মান দর্শনে হেগেল ও ফয়েরবাকের সমকালীন আধিপত্যের বিরুদ্ধে মার্কস ও এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। একই সঙ্গে তাঁরা সর্বহারার বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে কমিউনিস্ট লিগ গড়ে তোলেন।

এঙ্গেলস লিগের খসড়া কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন (১৮৪৭) যার ভিত্তিতে উভয়ের যুগ্ম লেখনীতে কমিউনিস্ট ইশতেহার (১৮৪৮) রচিত হয়। বলা যায় এই সময় থেকে শ্রমজীবী শ্রেণির মতাদর্শ হিসেবে মার্কসবাদের প্রচার শুরু হয়। সাংবাদিকতার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয় তাঁর সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জার্মানিতে ১৮৪৮-৪৯ খ্রি বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে এঙ্গেলসের ভাবনাচিন্তা প্রয়োগের সুযোগ পায়। বিপ্লবের ব্যর্থতায় তিনি জার্মানি ছেড়ে নির্বাসিত জীবনে প্রবেশ করেন।

ইংল্যান্ডে তিনি আবার মার্কসের সঙ্গে মিলিত হন এবং শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামে পুরােপুরি আত্মনিয়োগ করে প্রথম আন্তর্জাতিক পরিচালনা করেন (১৮৬৪-৭৬)। পরবর্তী প্রায় চার দশক যাবৎ এঙ্গেলস মার্কসের যাবতীয় রচনাদি বিশেষ করে ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটি প্রস্তুতির কাজে সাহচর্যে যুক্ত থাকেন। মার্কসের চিন্তা ও রচনায় এঙ্গেলসের প্রভাব ছিল অপরিমেয়। মার্কসের বহু তত্ত্বকে এঙ্গেলস বিস্তারিত ও বর্ধিত করেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্বকে প্রকৃতপক্ষে এঙ্গেলসই প্রযুক্তিগত দিক থেকে তুলে ধরেন। ‘অ্যান্টি ডুরিং’ গ্রন্থে লিখেছেন যে দ্বন্দ্ববাদের প্রতিফলন মনু ষ্যপ্রকৃতিতে ছাড়াও বস্তুজগতেও দেখা যায়। তিনি মনে করতেন একই নিয়মে মানুষ ও প্রকৃতি আবদ্ধ। ‘ডায়ালেকটিকস অব নেচার’ সেই নিরিখে লিখিত।

‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্র’ গ্রন্থে তিনি নারীবাদী তত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখিয়েছেন যে এক-বিবাহ প্রথা পুরুষ অথবা নারী, একের উপর অপরের আধিপত্য থেকে উদ্ভূত, যাতে বংশধরেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারে পিতৃত্বের বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ে। সামাজিক শ্রেণি বিরোধের আদি উৎস হলো নারী-পুরুষের এক বিবাহের বিরোধ; এবং শোষণ ও পীড়নও আদিকালে ঘটেছিল স্ত্রী-পুরুষের একজনের উপর অপরজনের আধিপত্য থেকে। গভীর অধ্যয়ন ও মৌল গ্রন্থাদি রচনার সমসময়ে এঙ্গেলস রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সমধিক সক্রিয় থাকতেন।

সমাজে বিকাশে মানুষের জীবিকার ভূমিকা প্রধান; কিন্তু ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকেও মার্কসবাদে নস্যাৎ করে না। জীবিকা যেমন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে, তেমনি আবার ব্যক্তিও তার মস্তিষ্ক ও মনের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা সেই বাস্তব জীবিকার অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা বহন করে।[৩]

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের অনবদ্য আকর্ষণীয় রচনা-রীতি মার্কসবাদের সামাজিক বিশ্লেষণ ও দার্শনিক অভিমতসমূহকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেক গ্রন্থেই তিনি মার্কসবাদের প্রতিপক্ষীয়দের অভিমতকে খণ্ডন করে ব্যাখ্যার মাধ্যমে মার্কসবাদের তত্ত্বে আপন মনীষার সংযোজন ঘটিয়েছেন। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত ধারণাকে সমালোচনা করে দেখান যে, দর্শনকে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বা এরূপ অতি-বাস্তব উচ্ছ্বাসমূল আখ্যাদান কৃত্রিম এবং অজ্ঞানতার পরিচায়ক। দর্শন কোনো রহস্যলোক নয়। দর্শনের ভূমিকা হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাকে সংযুক্ত করে জানার কৌশল উদ্ভাবনে মানুষকে সাহায্য করা, কোনো অতি-বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার নয়।

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, “ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান বিপ্লবী” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/friedrich-engels/
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৫১-১৫৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!