ইউক্লিড প্রাচীনকালের গ্রিক অঙ্কশাস্ত্রবিদ ও জ্যামিতিক

ইউক্লিড, (ইংরেজি: Euclid) যাকে কখনও কখনও আলেকজান্দ্রিয়ার ইউক্লিড বলা হতো, তাকে মেগার ইউক্লিড থেকে আলাদা করার জন্য, তিনি ছিলেন একজন গ্রীক গণিতবিদ, যাকে প্রায়শই “জ্যামিতির প্রতিষ্ঠাতা” বা “জ্যামিতির জনক” হিসাবে অভিহিত করা হয়। তিনি প্রথম টলেমির (৩২৩-২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজত্বকালে আলেকজান্দ্রিয়ায় সক্রিয় ছিলেন।[১]

ইউক্লিডের জন্ম আলেকজান্দ্রিয়ায়। জীবন-বৃত্তান্ত তেমন জানা যায় না। কিন্তু আধুনিককাল পর্যন্ত তাঁর জ্যামিতিক তত্ত্বসমূহ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের মূল পাঠ্য হিসাবে চলে এসেছে। কেবলমাত্র সাম্প্রতিককালে তাঁর তত্ত্বসমূহের পরিবর্তে নতুন তত্ত্ব প্রচারিত হচ্ছে।

ইউক্লিডের জ্যামিতিক তত্ত্ব অবরোহী বা ডিডাকটিভ অনুমানের প্রধান ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। ইউক্লিড তাঁর ‘ডাটা’ বা ‘ডিডোমেনা’ গ্রন্থে ৯৫টি থিওরেম পেশ করেছেন। এসব থিওরেমের প্রতিপাদ্য হচ্ছে এই তত্ত্ব যে, কতগুলি স্বতঃসিদ্ধ স্বীকার করলে তার ভিত্তিতে একাধিক সিদ্ধান্তকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলেকজান্দ্রিয় যুগটি অঙ্কশাস্ত্রের বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে বলে মনে করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়ার একাডেমীর অন্যতম অঙ্কবিদ ছিলেন ইউক্লিড।[২]

‘জ্যামিতিবিদ্যা শেখার কোনও সহজ রাস্তা নেই?’ রাজা জানতে চাইলেন গণিতবিদের কাছে।

‘না, রাজাদের জন্যে জ্যামিতি শেখার কোনও সোজা পথ নেই। মহারাজ, বস্তুত যে কোনও শিক্ষার জন্যেই রাজকীয় রাস্তা নেই।’ সটান জবাব গণিতবিদের।

আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগে আলেকজান্দ্রিয়ার সুখ্যাত রাজা প্রথম টলেমি ওই প্রশ্ন করেছিলেন যাঁকে, তিনি হলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই গণিতজ্ঞ ইউক্লিড।

ইউক্লিডীয় জ্যামিতি আজও স্কুলে অবশ্যপাঠ্য। তার সময়ের জ্যামিতির যাবতীয় জ্ঞান ও তথ্য অধ্যয়ন ও সংগ্রহ করে তেরোটি খণ্ডে বিন্যস্ত করেছিলেন গ্রিক গণিতজ্ঞ ইউক্লিড। এগুলিকে বলা হয় ‘ইউক্লিডস এলিমেন্টস’। এর সঙ্গে স্বরচিত কিছু উপপাদ্যও যোগ করেছিলেন তিনি। আর এই সব পুস্তকে জ্যামিতি যেভাবে আলোচিত হয়েছিল, শিক্ষিত বিদ্যোৎসাহী টলেমির কাছে তা দুর্বোধ্য লেগেছিল বলেই তিনি জ্যামিতি শেখার সোজা-সরল পথ বাতলাতে বলেছিলেন ইউক্লিডকে।

কর্মজীবনে ইউক্লিড

পিথাগোরাসের প্রায় দুশো বছর পরের মানুষ ইউক্লিড। কিন্তু তার জন্ম সময় এবং ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। শুধু এইটুকু জানা গিয়েছে যে, ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ধারে কাছে তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিলেন এবং সে কালে বিশ্বের ওই শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্রের মিউজিয়ামে শিক্ষকতা করতেন। কলা এবং বিজ্ঞানের নিবিড় চর্চা ও শিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল সেখানে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে শিক্ষক, পণ্ডিত ও ছাত্ররা ছুটে আসতেন তার অমোঘ আকর্ষণে। প্যাপিরাস তৈরির শিল্প ও পুস্তক ব্যবসার প্রধান কেন্দ্রও ছিল আলেকজান্দ্রিয়া।

ইউক্লিড সম্ভবত প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর অ্যাকাডেমিতে প্লেটোর শিষ্যদের কাছেই শিক্ষালাভ করেছিলেন। সে সময়ে গণিত শিক্ষণে ওই অ্যাকাডেমির বিশেষ খ্যাতি ছিল। শোনা যায়, রাজনৈতিক কারণে ইউক্লিড আলেকজান্দ্রিয়ার চলে যান এবং রাজা টলেমির সভায় সসম্মানে স্থান পান। প্রথম টলেমি নিজেও যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন এবং কবি চিত্রশিল্পী, জ্যোতিষবিদ, বিশেষ করে গণিতজ্ঞদের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। রাজা টলেমি আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। পরে যা এক মহা গ্রন্থাগারে পরিণত হয়। প্রায় সাত লক্ষ বই ছিল সেখানে। সবই প্যাপিরাসে লেখা। কারণ কাগজ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কালক্রমে অবশ্য তখনকার দিনে বিশ্বের ওই শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি ধ্বংস হয় রোমানদের হাতে।

সারা আলেকজান্দ্রিয়া জুড়েই খ্যাতির তুঙ্গে ছিলেন ইউক্লিড। গোড়ায় মিউজিয়াম বা গ্রন্থাগারে তিনি শিক্ষকতা করতেন। শোনা যায়, পরে তিনি নিজস্ব একটি স্কুলও চালু করেন। ইউক্লিড তেরো খণ্ডের বইগুলো লিখেছিলেন আরবি ভাষায়। দ্বাদশ শতকে সেগুলি ল্যাটিনে অনূদিত হয় এবং নাম দেওয়া হয় ‘এলিমেন্টস’। ল্যাটিন ভাষায় প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ বেরয় ১৪৮২ সালে ভেনিসে। আর গণিতবিদ জন ডি-র অনূদিত এলিমেন্টস-এর প্রথম ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৫৭০-এ।

এলিমেন্টস-এর প্রথম খণ্ডে ‘প্লেন জিওমেট্রি’ বা সমতলীয় জ্যামিতির অন্তর্গত বিন্দু, রেখা, বৃত্ত, ত্রিভুজ ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্যাদি আছে। দ্বিতীয় খণ্ডে আছে বীজগণিতের সাহায্যে বিভিন্ন জ্যামিতিক ‘ফিগার’ বা গঠন আঁকার পদ্ধতি। তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে রয়েছে বৃত্ত সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ও উপপাদ্য। পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে আছে অনুপাতের (রেশিও) তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগ বা ব্যবহার। একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড ‘সলিড জিওমেট্রি’ বা ঘন জ্যামিতি সম্পর্কিত আলোচনায় পূর্ণ। সরল ও ঘন জ্যামিতি সংক্রান্ত ৪৬৭টি ‘প্রোপোজিশন’ বা প্রস্তাবনা রয়েছে এলিমেন্টসে। সবগুলিই যুক্তির পথে প্রতিষ্ঠিত।

‘প্রাইম নাম্বার’ বা মৌলিক সংখ্যা সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা আছে এই মহাগ্রন্থে। যে সংখ্যা সেটিরই দ্বারা এবং ১ দিয়ে বিভাজ্য, তাই হলো মৌলিক সংখ্যা। যেমন ১, ২, ৩, ৫ ইত্যাদি। মৌলিক সংখ্যা অগণিত। কম্পিউটারের যুগে আজও নতুন নতুন মৌলিক সংখ্যা আবিষ্কৃত হচ্ছে। মৌলিক সংখ্যা সম্পর্কে ইউক্লিডের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো ‘বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যা বের করা অসম্ভব’। তত্ত্বটি চিরকালীন সত্য। কারণ, কোনও বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যাকে সেই সংখ্যা এবং তার আগে পর্যন্ত জ্ঞাত যাবতীয় মৌলিক সংখ্যা দিয়ে গুণ করে, সেই গুণফলের সঙ্গে ১ যোগ করলে আর একটি উচ্চতর মানের মৌলিক সংখ্যা মিলবে। এর কোনও শেষ নেই।

এলিমেন্টস-এর প্রথম ছয়টি খণ্ড আজও স্কুল স্তরে পাঠ্য জ্যামিতির ভিত্তি, যাকে বলা হয় ইউক্লিডীয় জ্যামিতি। এই বইয়ের শেষ তিন খন্ডে ছড়ানো ঘন জ্যামিতির আলোচনায় ঘনক, পিরামিড, স্ফিয়ার বা গোলক, অক্টাহেড্রন বা অষ্টতল বিশিষ্ট ঘনবস্তু (অষ্টতলক) ইত্যাদি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে। যেখানে ইউক্লিড জ্যামিতি বিদ্যায় তাঁর পূর্ববর্তী গবেষণার বিবরণ ছাড়াও নিজস্ব অনুসন্ধান ও প্রমাণাদির কথাও লিখেছেন। সব কটি খণ্ডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইউক্লিডের কাল পর্যন্ত জ্যামিতি বিদ্যার যাবতীয় তথ্যের অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ সমাবেশ। বিশ্ব জুড়ে নানা ভাষায় সেগুলি অনূদিত হয়েছে, যার মধ্যে বহু ভারতীয় ভাষাও আছে। বস্তুত, মুদ্রণ উদ্ভাবনের পর থেকে এ পর্যন্ত এলিমেন্টস-এর সহস্রাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এবং অনুমান, বিক্রির সংখ্যায় একমাত্র বাইবেল ছাড়া অন্য সমস্ত বইকে তা ছাড়িয়ে গিয়েছে।

ইউক্লিডের জ্যামিতির ভিত্তিতেই জার্মান গণিতজ্ঞ রিমান ‘ন-ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রি’ বা অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি উদ্ভাবন করেন। সমান্তরাল রেখা সম্পর্কে ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে বলা হয়েছে যে, কোনও সরলরেখার বাইরের কোনও বিন্দু থেকে ওই রেখার সমান্তরাল করে একটি মাত্র সরলরেখা টানাই সম্ভব। আধুনিক জ্যামিতিতে যাকে ধ্রুব বলে মেনে নেওয়া হয়নি। উনিশ শতকে লোভাচেভস্কি, বোলিয়াই প্রমুখ গণিতজ্ঞ দেখিয়েছেন যে, অধিবৃত্ত (প্যারাবোলা) ও পরাবৃত্ত (হাইপারবোলা) ভিত্তিক জ্যামিতির ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়।

মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ইউক্লিডের ভক্ত ছিলেন। তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বে এই জ্যামিতিরই সাহায্য নেওয়া হয়েছে। আইনস্টাইন বলেছেন, ইউক্লিডই জ্যামিতি বিদ্যায় যুক্তিভিত্তিক চিন্তার জনক। ইউক্লিডের আর এক বিখ্যাত ভক্তের নাম আব্রাহাম লিঙ্কন। যৌবনে তিনি যখন ঘোড়ায় চড়ে ঘোরা আইনজীবী ছিলেন, তখন তার স্যাড়লব্যাগে থাকত ইউক্লিডের এলিমেন্টস-এর একটি কপি। যুক্তি সাজানোর কাজে এই বইয়ের সাহায্য নিতেন তিনি।

অকাট্য যুক্তিতে বাঁধা চিন্তার জন্যেই বিজ্ঞান জগৎ আবহমান কাল ইউক্লিডকে কুরনিশ করে এসেছে, করবে আগামী কালও।[৩]

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ২১ মে ২০১৯, “ইউক্লিড প্রাচীনকালের গ্রিক অঙ্কশাস্ত্রবিদ ও জ্যামিতিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/euclid/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৬০।
৩. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ৩০-৩২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!