আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মার্কিন সাংবাদিক, উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও ক্রীড়াবিদ

হেমিংওয়ে বা আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে (ইংরেজি: Ernest Miller Hemingway, ২১ জুলাই, ১৮৯৯ – ২ জুলাই, ১৯৬১) একজন মার্কিন সাংবাদিক, উপন্যাসিক, ছোট গল্পের লেখক এবং ক্রীড়াবিদ ছিলেন। তাঁর নির্মেদ আর স্বল্পবাক শৈলীকে তিনি আইসবার্গ তত্ত্ব বলে অভিহিত করেছিলেন। হেমিংওয়ে তার বেশিরভাগ রচনা ১৯২০-এর দশকের বছরগুলোর মাঝামাঝি থেকে ১৯৫০-এর দশকের বছরগুলোর মাঝামাঝি সময়ে রচনা করেছিলেন। তিনি জীবিতকালে সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোটগল্প সংগ্রহ এবং দুটি অকথাসাহিত্য (nonfiction) প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্প সংগ্রহ এবং তিনটি অকথাসাহিত্য প্রকাশিত হয়েছিল।

তাঁর রচনাশৈলী একদিকে বিশ শতকের কথাসাহিত্যের উপর দৃঢ় প্রভাব ফেলেছিল, অন্যদিকে তার দুঃসাহসিক জীবনযাত্রা ও ভাবমূর্তি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাকে প্রশংসিত করে তোলে।

হেমিংওয়ে তার বেশিরভাগ রচনা ১৯২০-এর দশকের বছরগুলোর মাঝামাঝি থেকে ১৯৫০-এর দশকের বছরগুলোর মাঝামাঝি সময়ে রচনা করেছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনি জীবিতকালে সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোটগল্প সংগ্রহ এবং দুটি অকথাসাহিত্য (nonfiction) প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্প সংগ্রহ এবং তিনটি অকথাসাহিত্য প্রকাশিত হয়েছিল।

তাঁর গল্প সংকলন The Short Stories of Ernest Hemingway-এর মুখবন্ধে হেমিংওয়ে তার নিজ পছন্দের ছোটগল্পের একটি তালিকা দিয়েছেন। গল্পগুলো হচ্ছে — ‘The Short Happy Life of Francis Macomber’, ‘In Another Country’, ‘Hills Like White Elephants’, ‘A Way You’ll Never Be’, ‘The Snows of Kilimanjaro’, ‘A Clean Well-Lighted Place’ ও ‘The Light of the world’। তার নিজের ভাষায় যে গল্প তিনি ছাড়া আর কারো কখনো ভালো লাগে নি। তাঁর অনেকগুলি রচনা পরবর্তীকালে মার্কিন ধ্রুপদী সাহিত্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।[১]

হেমিংওয়ের জন্ম

১৮৯৯ সালের কথা, ডাক্তার ক্লারেন্স হেমিংওয়ে আর গায়িকা গ্রেস হেমিংওয়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয়েস রাজ্যের শিকাগোর ওক পার্কের বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন আর্নেস্ট। হেমিংওয়ের বাল্যকাল কেটেছে বিচিত্র পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে। বাবা ছিলেন ডাক্তার। আর শিকার পাগল মানুষ। হেমিংওয়ে শিকারে হাত পাকিয়ে ছিলেন ছেলেবেলায় বাবার কাছ থেকেই।

অন্য দিকে মা ছিলেন সংগীত রসিক। তার ইচ্ছা ছিল ছেলে সংঙ্গীতজ্ঞ হবে। পিতামাতা দুজন ভিন্ন রুচির মানুষ, ফলে তাদের মধ্যে কারণে অকারণে অশান্তি আর খিটিমিটি লেগেই থাকত। এই পরিবেশে হেমিংওয়ের মন স্বভাবতঃই নিঃসঙ্গতা বোধের শিকার হয়ে পড়েছিল।

১৯১৩ থেকে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হেমিংওয়ে ওক পার্ক অ্যান্ড রিভার ফরেস্ট হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ জন্মাতে থাকে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। হেমিংওয়ে শৈশব থেকেই খেলাধুলা করতে খুব পছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই মুষ্টিযুদ্ধ, ওয়াটার পোলো অথবা ফুটবল খেলতে নেমে পড়তেন।

বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন, স্টিফেন ক্রেইন কিংবা সিনক্লেয়ার লুইসের মতো হেমিংওয়েও লেখালেখি আরম্ভ করেন সাংবাদিক হিসেবে। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীনই স্কুলের সংবাদপত্র ‘ট্রাপিজি এন্ড টাবুলা’ (Trapeze and Tabula) তে খেলাধুলা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। পড়ালেখা শেষ করে ‘ক্যানসাস সিটি স্টার’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন হেমিংওয়ে। সফল সাহিত্যিক হিসেবে তার পরবর্তী জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছিল এই সাংবাদিকতা। তাই সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি আর ক্যানসাস সিটি স্টার পত্রিকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একবার বলেছিলেন যে,

“On the Star you were forced to learn to write a simple declarative sentence. This is useful to anyone. Newspaper work will not harm a young writer and could help him if he gets out of it in time.”

“ঐ পত্রিকায় তিনি সাধারণ বিবৃতি বা বর্ণনামূলক বাক্য লেখা শিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটি যে কারও কাজে লাগে। সংবাদপত্রের কাজ একজন তরুণ লেখকের ক্ষতি করবে না এবং যদি সময়মতো এটি থেকে একজন তরুণ লেখক বেরিয়ে আসেন তবে সংবাদপত্রের কাজ সহায়ক হতে পারে।”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেমিংওয়ে

১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধাহতদের সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছোট শহর ক্যানসাসে স্বেচ্ছাসেবীদের খোঁজে আসা রেডক্রসের দলে যোগ দিলেন হেমিংওয়ে। ১৯১৮ সালের প্রথম দিকে হেমিংওয়ে ক্যানসাস সিটিতে রেডক্রসের নিয়োগ কার্যক্রমে সাড়া দেন এবং অ্যাম্বুলেন্সের চালক হিসাবে কাজের উদ্দেশ্যে ইতালীয় রণাঙ্গনে যাত্রা করেন। তিনি মে মাসে নিউ ইয়র্ক সিটি ছেড়ে যান এবং প্যারিস পৌছেঁ দেখেন শহরটি জার্মান গোলন্দাজ বাহিনী কর্তৃক বোমাবিধ্বস্ত। মিলানে উপস্থিত হবার দিনই তাকে একটি যুদ্ধোপকরণ কারখানার বিস্ফোরনস্থলে পাঠানো হয়, সেখানে উদ্ধারকর্মীরা নারী শ্রমিকদের লাশের টুকরো টুকরো অংশ উদ্ধারের চেষ্টা করছিল। তিনি এই ঘটনার কথা তার ডেথ ইন দি আফটারনুন বইতে বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, ‘আমার মনে আছে আমরা গোটা মৃতদেহ খুঁজছিলাম কিন্তু পাচ্ছিলাম মৃতদেহের টুকরো টুকরো অংশ’।

রেডক্রসে থাকাকালীন তিনি অ্যাগনেস ভন কুরভ্‌স্কি নামে এক নারীর প্রেমে পড়েন। সেই নারী রেডক্রসের একজন নার্স ছিলেন এবং বয়সে ছিলেন হেমিংওয়ের চেয়ে ৭ বছরের বড়। হেমিংওয়ে এবং অ্যাগনেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকাতেই তাদের বিয়ে হবে।

যারা পড়তে চাইছেন না, তারা ইউটিউবে তার জীবনীটি দেখুন নিচের ক্লিক করে

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জীবনীটি দেখুন ইউটিউবে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরা

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে হেমিংওয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। যদিও মার্চ মাসে অ্যাগনেস হেমিংওয়েকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তিনি একজন ইতালীয় অফিসারকে বিয়ে করে ফেলেছেন। জীবনীকার জেফ্রি মেয়ার হেমিংওয়ে, একটি জীবনী গ্রন্থে লিখেন হেমিংওয়ে এই ঘটনায়ে ভেঙে পড়েছিলেন। বিশ বছর বয়সে জীবনের প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কিন্তু ব্যর্থ হেমিংওয়ে এখান থেকেই জোগাড় করলেন তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’-এর অনুপ্রেরণা। যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা তাঁর ১৯২৯ সালে রচিত উপন্যাস অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস-এর ভিত্তি তৈরি করেছিল।

১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হেমিংওয়ে তার হাই স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মিশিগানের উর্ধ্বস্থ উপদ্বীপে মাছ ধরা ও ক্যাম্পিং সফরে যান। এই আনন্দ ভ্রমণ তার বিগ টু-হার্টেড রিভার ছোটগল্পের অনুপ্রেরণা ছিল। অর্ধ-আত্মজীবনীমূলক এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিক অ্যাডামস যুদ্ধ থেকে ফিরে স্বস্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়াতে যায়। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ ও ক্যাম্পিং তাকে ভ্রমণ অভিলাষী, উত্তেজনাকর ও রোমাঞ্চপ্রিয় করে তোলে। কাজ খুঁজে না পেয়ে তিনি টরন্টো স্টার পত্রিকাতে একাধারে ফ্রিল্যান্সার ও স্টাফ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই পত্রিকার সাংবাদিক কানাডার এক সাহিত্য বিস্ময় মর্লে কালাঘানের সাথে সেই সময়ে তার পরিচয় হয় এবং কালাঘান তার লেখার প্রশংসা করেন। ১৯২০ সালের জুন মাসে তিনি মিশিগানে ফিরে আসেন।

প্যারিস প্রত্যাবর্তন

১৯২১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর হেমিংওয়ে হ্যাডলি রিচার্ডসনকে বিয়ে করেছিলেন। তারা উভয়েই প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি টরন্টো স্টারের বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে চাকরি পান এবং তারা টরন্টো ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমান। সেখানেই তিনি ১৯২০-এর দশকের প্রবাসী সম্প্রদায় “হারানো প্রজন্ম“-এর আধুনিকতাবাদী লেখক এবং শিল্পীদের প্রভাবে পড়েছিলেন। প্যারিসে হেমিংওয়ে মার্কিন লেখিকা ও শিল্পকলা সংগ্রাহক গারট্রুড স্টেইন, আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস ও মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড ও অন্যান্য লেখকদের সাথে পরিচিত হন।

১৯২৫ সালে প্রকাশিত ইন আওয়ার টাইম হচ্ছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছোট গল্পের প্রথম সংকলন; এবং এই সংকলনের গল্প ক্যাট ইন দ্য রেইন সম্পর্কে আমরা অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য সান অলসো রাইজেস ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আগস্টে প্যারিসে তিনি চূড়ান্ত মুদ্রণ সংশোধন করেন এবং অক্টোবর মাসে স্ক্রিবনার্স থেকে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি যুদ্ধ-পরবর্তী প্রবাসী প্রজন্মকে নিয়ে রচিত একটি সংক্ষিপ্তসার।

উপন্যাসটি রচনাকালে হ্যাডলির সাথে হেমিংওয়ের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ১৯২৬ সালের শুরুতে হ্যাডলি পলিন ফাইফারের সাথে হেমিংওয়ের সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। পলিন পাইফার ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক। ফাটল ধরে হেমিংওয়ের সংসারে। ১৯২৭ সালের মে মাসে হ্যাডলি রিচার্ডসনকে ডিভোর্স তিনি দিয়ে বিয়ে করেন পলিন পাইফারকে। এ সময় হেমিংওয়ে লেখা শুরু করেন তার ছোট গল্প সংকলন ‘Men Without Women’।

১৯২৭ সালে হ্যাডলি রিচার্ডসনের সাথে তাঁর বিয়ে বিচ্ছেদ হয় এবং একই বছর পলিন ফাইফারকে বিয়ে করেছিলেন।

হেমিংওয়ের ফ্লোরিডার বাড়ি ও যাদুঘর

১৯২৮ সালের মার্চে তারা প্যারিস ত্যাগ করেন। পলিনের চাচা কি ওয়েস্টে তাদেরকে একটি বাড়ি কিনে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টে অবস্থিত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়িটি ওয়েস্ট বাতিঘরের পাশে ৯০৭ হোয়াইটহেড স্ট্রিটে অবস্থিত। ১৯৬৮ সালের ২৪শে নভেম্বর এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষিত হয়।

বাড়িটি দ্বীপের প্রথম দিককার একটি যা অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন ঘর সাজানোর জিনিস দিয়ে সাজানো ছিল এবং দ্বীপের প্রথম পর্যায়ের বাড়ি হিসেবে এটির ছাদ থেকে বৃষ্টির পানিকে জলাধারে রেখে দোতলায় একটি স্নানঘর বানানো হয়েছিল। এছাড়াও বাড়িটি উল্লেখযোগ্য ছিল কারণ সেখানে একটি অন্তর্নির্মিত চুল্লী এবং কী ওয়েস্টের প্রথম সুইমিং পুল ছিল। ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগে এটি ছিল ১০০ মাইলের মধ্যে একমাত্র সুইমিং পুল। এই বাড়িটিতে হেমিংওয়ের একটি লেখার ঘর, বিদেশে অভিযানের সময় তাঁর সংগৃহীত ট্রফি, ব্যবহৃত বই এবং আরো আছে তার সময়ে থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা কয়েকটি বিড়াল।

এরই মধ্যে তিনি ইউরোপ ও কিউবায় ভ্রমণ করতে থাকেন। যদিও ১৯৩৩ সালে তিনি কি ওয়েস্ট সম্পর্কে লিখেছিলেন, “এখানে আমাদের একটি সুন্দর বাড়ি রয়েছে, এবং বাচ্চারা সকলেই ভালো আছে”।

স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকে কিউবায়

হেমিংওয়ে ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি মার্চ মাসে ওলন্দাজ চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়োরিস আইভেন্সের সাথে স্পেনে পৌঁছান। আইভেন্স রিপাবলিকানদের পক্ষে দ্য স্পেনিশ আর্থ নামে একটি প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন। এই যুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে মার্থা গেলহর্ন নামে এক নারী সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হয় হেমিংওয়ের। মার্থার অনুপ্রেরণাতেই হেমিংওয়ে রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা শুরু করেন তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘For Whom the Bell Tolls’, যেটি পরবর্তীতে পুলিৎজার পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হয়। মার্থার সাথে হেমিংওয়ের এই সম্পর্ক তার পরিবারে আবারো ভাঙন ডেকে আনে।

পলিন পাইফারকে ডিভোর্স দিয়ে মার্থা গেলহর্নকে ১৯৪০ সালে বিয়ে করেন হেমিংওয়ে।
মার্থাকে নিয়ে ১৯৪০ সালে হেমিংওয়ে কিউবা চলে আসেন। রাজধানী হাভানা থেকে খানিকটা দূরেই একটা বাগানবাড়ি কিনেছিলেন হেমিংওয়ে। উত্তাল সমুদ্রে মাছ শিকার করতে দারুণ পছন্দ করতেন হেমিংওয়ে। উত্তাল সমুদ্রে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের নিত্যদিনের কাজের সাথে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছিলেন তিনি। কালজয়ী উপন্যাস ‘The old man and the sea’ এর উপাদানগুলোও সংগ্রহ করে চলছিলেন তিনি। তবে হেমিংওয়ে সাংবাদিকতার সাথে তখনও যুক্ত ছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে খবর সংগ্রহে

১৯৪১ সালে যখন চীন-জাপান যুদ্ধ চলছে, তখন মার্থা আর হেমিংওয়ে পাড়ি জমান চীনে যুদ্ধের খবর সংগ্রহের জন্য। তবে আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের আগেই হেমিংওয়ে আর মার্থা আবারো কিউবা ফেরত আসেন।

১৯৪৪ সালের মার্চ থেকে ১৯৪৫ সালের মে পর্যন্ত হেমিংওয়ে লন্ডন ও ইউরোপে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের পরপরই সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তার এই ইউরোপে আসা। ১৯৪৪ সালের ২৫ আগস্ট, তিনি জার্মানির হাত থেকে প্যারিসের মুক্তির সময় সাংবাদিক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন; হেমিংওয়ের এই কিংবদন্তির বিপরীতে বলা যায় তিনি শহরে প্রথম ছিলেন না, কিংবা তিনি রিটজকেও মুক্ত করেননি।

ইউরোপে এসে তার সাথে দেখা হয় টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ম্যারি ওয়েলস-এর সাথে। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। আর তাই ১৯৪৫ সালে তৃতীয় স্ত্রী মার্থাকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করেন ম্যারি ওয়েলসকে। হেমিংওয়ে নর্ম্যান্ডি অবতরণ এবং প্যারিসের মুক্তির সময় সাংবাদিক হিসাবে সেনাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন।

কিউবা ও নোবেল পুরস্কার

হেমিংওয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কিউবায় তার বাড়িতে অবস্থানকালে লেখক হিসেবে তেমন কিছু লেখেননি। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে তিনি কয়েকটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হন। একের পর এক তার সাহিত্যিক বন্ধুগণ মারা যেতে থাকলে হেমিংওয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়েন।এই সময়ে পূর্ববর্তী দুর্ঘটনা ও অনেক বছরের অত্যধিক মদ্যপানের কারণে তিনি তীব্র মাথা ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন হ্রাস, ও ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকেন।

১৯৫২ সালে দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী প্রকাশের কিছুদিন পর হেমিংওয়ে আফ্রিকায় সাফারি ভ্রমণে যান। ১৯৫৪ সালে সেখানে তিনি পরপর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পান, কিন্তু বাকি জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কাটান।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন “আধুনিক বর্ণনা শিল্পে তাঁর শক্তিশালী, শৈলি-গঠনকারী দক্ষতার জন্য, যেটি সাম্প্রতিককালের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’-এ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে”।

হেমিংওয়ের শেষ দিনগুলো

তিনি ১৯৩০-এর দশকে ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টে এবং ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে কিউবায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহোর কেচামে একটি বাড়ি ক্রয় করেন। ১৯৬০ সালের ২৫শে জুলাই হেমিংওয়ে ও ম্যারি কিউবা ছেড়ে চলে যান এবং কখনো আর সেখানে ফিরেন নি। কেচামে এফবিআই সর্বক্ষণ তার কর্মকাণ্ড নিরীক্ষণ করছে এই ভেবে তার মধ্যে ভ্রম-বাতুলতা দেখা দেয়। এফবিআই সত্যিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। ফলে হেমিংওয়েকে স্যাভিয়ার্সের মায়ো ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছিল। মায়োতে হেমিংওয়ের চিকিৎসা গোপনীয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল।

মায়ো ক্লিনিক থেকে ছাড়া পাওয়ার তিন মাস পরে হেমিংওয়েকে ১৯৬১ সালের এপ্রিলে একদিন সকালে ম্যারি শর্টগান হাতে রান্নাঘরে দেখতে পান। বিষয়টি উদ্বিগ্ন হবার। তাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয় ও সান ভ্যালি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তাকে আরও বৈদ্যুতিক শক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আবার মায়ো ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। জুন মাসের শেষের দিকে তিনি মায়ো থেকে ছাড়া পান এবং ৩০শে জুন কেচামে নিজ বাড়িতে আসেন।

১৯৬১ সালের ২ জুলাই সকালে নিজের প্রিয় দোনলা বন্দুকটা মাথায় ঠেকালেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। পরপারে পাড়ি জমালেন কালজয়ী উপন্যাস দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড সী সহ অনেক ধ্রুপদী বইয়ের রচয়িতা এই সাহিত্যিক। তার কর্মমুখর জীবনে তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন, তিনটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, দুবার বিমান বিধ্বস্ত হয়েও বেঁচে গেছেন, চারজনকে বিয়ে করেছেন।

বন-অরণ্য কিংবা সমুদ্রে শিকার করতে ভীষণ পছন্দ করা এই মানুষটি তার পাখি শিকার করার দোনলা বন্দুক বা শটগান দিয়ে নিজের মাথার খুলি উড়িয়ে দেবেন তা অনেকটাই অভাবনীয়।

কেননা তার লেখা দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী নামক কালজয়ী উপন্যাসে আমরা দেখি বৃদ্ধ সান্তিয়াগো বলছে,

“Man is not made for defeat . . . [a] man can be destroyed but not defeated”

হেমিংওয়ে কি নিজেই হতাশার কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? জীবনের রণক্ষেত্রে মাত্র ৬১ বছর বয়সেই ইস্তফা দিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কিন্তু কেন এই বিদায়? মৃত্যুর খবর চাউর হবার পরপরেই তার স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে সাংবাদিকদের বলেন,

“আর্নেস্ট ভোরে শিকারে বের হবার আগে হয়তো তার বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন, ভুলক্রমেই হয়তো বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়েছে।”

হেমিংওয়ের বিচিত্র মানসিকতা

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তার বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে, ভাই লিস্টার হেমিংওয়ে আর বোন উরসালা হেমিংওয়েও আত্মহত্যা করেছেন। হেমিংওয়ে পরিবারের রক্তেই মিশে আছে এই আত্মহত্যার ধারা, অথবা হয়ত তারা ভুগছিলেন কোনো মানসিক অসুখে।

সাহিত্য রচনার সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্মালেও হেমিংওয়ে বাল্য বয়স থেকেই বিচিত্র মানসিকতার শিকার হয়ে পড়েছিলেন। বলাই বাহুল্য বাবা-মায়ের অ-মিল সংসার থেকেই এই অস্থিরতা তার মধ্যে বাসা বেঁধে ছিল। যৌবনে নিজে যখন বিয়ে করলেন, বারবার নিজের সংসার ভাঙ্গল, গৃহসুখ বা সংসার বন্ধন বলে কিছুই প্রায় ছিল না তার। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারবার বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তার জীবনে। তার চতুর্থ স্ত্রী মারী ছিলেন ওয়েলস ডেলি এক্সপ্রেসের ফিচারিস্ট। জীবনে চরম প্রতিষ্ঠার সময়ে এই স্ত্রীই ছিলেন তার পাশে।[২][৩]

তথ্যসূত্র

১. কাওসার হুসাইন, ‘অনুবাদ প্রসঙ্গে’ হেমিংওয়ের গল্প, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০৪, পৃষ্ঠা ৯।
২. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১৩৭-১৩৮।
৩. লেখাটি ২-৩ জুন ২০২০ তারিখে লেখা হয়েছিল এবং ৩ জুন রোদ্দুরে ডট কমের জীবনী বিষয়শ্রেণিতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে ফুলকিবাজে প্রকাশিত হয়েছে এবং পুনঃপ্রকাশের সময় পরিবর্ধন করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!