দান্তে বা দান্তে আলিঘিয়েরি বা দান্তে আলিগিয়েরি (ইংরেজি বানানে: Dante Alighieri) পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম। বাইবেল এবং শেক্সপীয়রের রচনাবলী ছাড়া পৃথিবীর অপর কোনো সাহিত্য দান্তে রচিত অমর মহাকাব্য Divina Commedia’র মত ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি।
সম্ভবত ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরে জন্মগ্রহণ করেন। সেই যুগে ইতালি ছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। এক স্টেটের সঙ্গে আরেক স্টেটের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। সকলের ওপর রাজার সঙ্গে পোপের দ্বন্দ মাঝে মাঝেই ভয়ানক রূপ নিত।
সেই সময়ে ভেনিস হয়ে উঠেছিল সম্পদে ও শক্তিতে প্রবল প্রতাপশালী। ভেনিসের সম্পদের গরিমা কিংবদন্তির রূপ লাভ করেছিল। ভেনিসের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফ্লোরেন্স। এই প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল সম্পদে, শক্তিতে, শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে সমান রকম। দান্তের জন্মস্থান ফ্লোরেন্স থেকেই ইউরোপের নবজাগরণের সুত্রপাত হয়েছিল। আর সেই রেনেসাঁর অন্যতম অগ্রবর্তী সেনানী ছিলেন দান্তে।
পিতা ছিলেন ফ্লোরেন্সের একজন অভিজাত আইনজীবী। পুত্রকে পরিবারের উপযুক্ত উত্তরাধিকারী করে গড়ে তুলতে তার যত্নের ত্রুটি ছিল না। দান্তে ক্রমেই শিক্ষায় আচারে, আচরণে পরিশীলিত হয়ে উঠতে লাগলেন। দান্তে জন্মগতভাবে পেয়েছিলেন অন্তহীন জিজ্ঞাসা আর সীমাহীন কৌতূহল। সবকিছুর প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করতেন তিনি। জানতে চেষ্টা করতেন অন্তর্গূঢ রহস্য। অনন্ত রহস্যের আধার প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য আর সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছিল তাকে। মনে প্রাণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সৌন্দর্যের পূজারী।
পিতার সতর্ক ও সযত্ন প্রহরায় মধ্যযুগীয় অশিষ্টতার প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকতে পেরেছিলেন দান্তে। গৃহেই তার শিক্ষারম্ভ হয়েছিল ব্রুনেতো লাতিনি নামের এক শিক্ষকের কাছে।
ব্রুনেতো ব্যক্তিগত জীবনে উদ্ধৃঙ্খল চরিত্রের মানুষ হলেও তার মধ্যে ছিল নিটোল এক বিজ্ঞান ও সুস্থ সাংস্কৃতিক সত্তা। দান্তে তার সাহচর্যে বাল্য বয়স থেকেই নবজাগরণের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। ব্রুনেতোই কিশোর দান্তের সৌন্দর্য অনুরাগী কবিমনকে কল্পনাপ্রবণ ও পরিশীলিত করে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।
মাত্র নয় বছর বয়সেই দান্তে বিয়াত্রিচ নামের আট বছরের এক বালিকাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসেন। দুজনের বয়স নিয়ে নানা মহলে মত পার্থক্য আছে। তবে এটা জানা যায় যে কবি এই কিশোরী প্রেমিকাকে লোকলজ্জার ভয়ে কখনোই তার অন্তরের কথা জানাতে পারেননি। এই প্রেমের কথা চিরকালই তার অন্তরে গোপন ছিল। দুজনের মিলন কখনোই সম্ভব হয়নি।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বিয়াত্রিচের মৃত্যু হলে কবি গভীর শোকে অভিভূত হন। এই শোকই তাঁর কবি জীবনের মূলে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা যোগায়। প্রেমিকা বিয়াত্রিচের নামকে কবি অমর করে গিয়েছেন তার The Divine Comedy আর Vita Noeva তে।
ভগ্ন হৃদয় কবি অবশ্য যৌবনে বিয়ে করেছিলেন জেম্মা কারসো দেনাতি নামের এক রূপসী তরুণীকে। দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। পরবর্তিকালে কারসো দোনাতি তার শত্রু হয়ে উঠেছিলেন। চরম অসহিষ্ণুতার যুগে চির সহিষ্ণু কবি অবশ্য কখনোই সরাসরি স্ত্রীর নিন্দা করেননি। তবে ইনফারনো গ্রন্থের একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন নিজের স্ত্রীর আদলে। সেই নারী ছিল হিংস্র মেজাজের।
নগর রাষ্ট্রের একজন প্রধান নাগরিক রূপে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন দান্তে। এবং অনিবার্য ভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ফ্লোরেন্স শহরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল দেশের দুটি সংস্থার ওপর। দান্তে তাদের একটি সংস্থার সদস্য ছিলেন। পরে নিজের কর্মদক্ষতায় সংস্থার অধ্যক্ষ লাভ করেছিলেন।
দুটি রাজনৈতিক দলেরই প্রাধান্য ছিল ফ্লোরেন্সে। একটি হলো পোপের পক্ষভুক্ত Guelfs এবং অপরটি সম্রাটের পক্ষভুক্ত গিবেল্লিনেস (Ghibellines)। এই দুই শক্তির দ্বন্দ্বের ফলে ইতালি খন্ড খন্ড হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে অষ্টম পোপ বনিফেস একশ নাইটকে এমন কিছু নাগরিককে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যাঁরা ছিলেন তার ব্যক্তিগত শত্রু। দান্তে এই নির্দেশকে অযৌক্তিক মনে করে তীব্র বিরোধিতা করেন। তার বিরুদ্ধাচরণের ফলে ফ্লোরেন্সে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় আরনো নদীর জল রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল।
এই দাঙ্গায় চরমপন্থী Black Guelf দলের জয় সূচিত হলে তারা বিরোধী White Guelf দলের নেতাদের নির্বাসনে পাঠাতে আরম্ভ করল। দান্তের বিরুদ্ধেও মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে জীবন্ত দগ্ধ করবার আদেশ দেওয়া হল।
বাধ্য হয়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সে ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে দান্তেকে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে দেশান্তরে চলে যেতে হয়েছিল। ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাকে দেশের বাইরে নির্বাসন জীবন কাটাতে হয়েছিল।
এই সময়ে দান্তে লেম্বার্ডি, তাসকানিও রোগনায় হিতৈষীদের আশ্রয়ে কাটিয়েছেন। শোনা যায় তিনি পাারিসেও এসেছিলেন। ভেরোনায় কবি অবস্থান করেছিলেন লর্ডের পুত্র কান গাঁদ্রে দ্য লাস্কালা-এর আশ্রয়ে। সেখান থেকে তিনি চলে গিয়েছিলেন রাভেন্না।
রাভেন্নার শাসক তাকে দূতের দায়িত্ব দিয়ে ভেনিসে পাঠিয়েছিলেন। দৌত্য ব্যর্থ হওয়ায় তিনি রাভেন্নাতেই ফিরে গিয়েছিলেন। এখানেই কবি মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এখানকার সেন্ট ফ্রান্সিস গীর্জায় তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়।
প্রেমিক, রাজনীতিক ও মানবতাবাদী কবি দান্তে লাতিন ভাষায় কাব্যতত্ত্ব, রাজনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ ও অনেক প্রবন্ধ রচনা করেন।
নির্বাসন জীবনে থাকাকালীন সময়েই তিনি তার প্রেরণাদাত্রী বিয়াত্রিচের স্মরণে রচনা করেন ডিভাইনা কম্মেদিয়া (Divina Commedia) গ্রন্থটি। নরক (Inferno), শোধন ভূমি (Purgatoris) এবং স্বর্গ (Paradise) নামক তিনটি খন্ডে এবং শত সর্গে বিভক্ত এই কাব্যে কবি মানুষের মনকে পর্যায়ক্রমে নরক, শোধন ভূমি ও স্বর্গের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেছেন।
পৃথিবী থেকে স্বর্গ পর্যন্ত তার এই কাব্য-যাত্রায় নায়িকা হচ্ছেন বিয়াত্রিচ। বিয়াত্রিচই তাকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সর্বশেষে স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে এসে তিনি ফিরে দেখেন, তার পথের সাথী সেই আলোক-প্রতিমা বিয়াত্রিচ আর নেই। কবির অন্তরাত্মা আকুল হয়ে কেঁদে উঠল বিয়াত্রিচ তুমি কোথায়?
পাশ থেকে একজন উত্তর দিল, দূরে, স্বর্গকে ছাড়িয়ে বহুদূরে নতুন এক আলোকলোকে বিয়াত্রিচ তোমারই পথ চেয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে। সে সেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাস করছে। কবি নতজানু হয়ে প্রার্থনায় বসেন। এখানেই এই রোমান্টিক মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি।
পাশ্চাত্য জগতের ধ্রুপদী সাহিত্য ও খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্য ধারার মিশ্রণে কবি এই গ্রন্থটি রচনা করেন। দান্তের মৃত্যুর অল্পকালের মধ্যেই তিনি ইতালির শ্রেষ্ঠ মানবরূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। বস্তুত তাঁর রচনা ছিল আধুনিক ও প্রাচীন যুগের মধ্যে সেতুবন্ধন।
মৃত্যুর কিছুকাল আগে দান্তে রচনা করেছিলেন দ্য মনার্কিয়া, যে গ্রন্থ সমগ্র ইতালি জুড়ে তুলেছিল বিতর্কের ঝড়। এই গ্রন্থে গির্জা অধ্যক্ষদের ক্ষমতা হ্রাসের স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই লেখা তাদের কোপে পড়ল। পোপকে বাধ্য হয়ে তার বিধান ঘোষণা করে বলতে হয়েছিল গির্জাই পার্থিব ও আধ্যাত্ম বিষয়ের অধিকর্তা।
পোপের নির্দেশে দ্য মনার্ক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। প্রকাশ্যে গ্রন্থটি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। গির্জার অধ্যক্ষদের রোষের এখানেই নিবৃত্তি হয়নি। তারা পরিকল্পনা নিয়েছিলেন কবর খুঁড়ে দান্তের কঙ্কাল তুলে এনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তারা তা করতে পারেননি।
রাভেন্নার জনপ্রতিনিধিরা বাধা দিয়ে কবির প্রতি চরম অপমান রোধ করেছিলেন। রাভেন্নার গির্জাধ্যক্ষরা দান্তের কঙ্কালটি গির্জার ভেতরে গোপন করে ফেলেছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিঃ দান্তের কঙ্কালটি উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু চোয়াল অংশ পাওয়া যায়নি। এই কঙ্কাল একটি অলঙ্কৃত কফিনে রেখে মূল সমাধিক্ষেত্রে পুঃনস্থাপিত করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১০২-১০৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।