ডি এইচ লরেন্স ইংরেজ কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সমালোচক ও প্রাবন্ধিক

ডেভিড হারবার্ট লরেন্স বা ডি এইচ লরেন্স (ইংরেজি: David Herbert Lawrence, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫ – ২ মার্চ, ১৯৩০) ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের একজন কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর সংগৃহীত রচনাগুলি অন্যান্য বহুবিধ বিষয়ের মধ্যে আধুনিকতা এবং শিল্পায়নের অমানবিক ফলাফলগুলির প্রতি বিস্তৃত প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করেছিল।[১]

বেশিরভাগ লেখায় লরেন্স অন্যদের মধ্যে যৌনতা, প্রবৃত্তি, জীবনীশক্তি, স্বতঃস্ফূর্ততার মতো বিষয়গুলিকে নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায়, লরেন্স তার দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার কাজের ভুল উপস্থাপনার কারণে বিবাচন (ইংরেজি: censored) ও হয়রানিতে পড়েছিলেন।

বিশ শতকের প্রথম দিককার মধ্যপন্থী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাসে কিছুটা অভিনবত্ব আছে। প্রথমত, তার উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার আত্মজিজ্ঞাসা আরও একটু গভীরতর এবং তাদের মনোবিকলনে লরেন্স ফ্রয়েডীয় পদ্ধতি দ্বারা বেশ কিছুটা প্রভাবান্বিত। ডিকেন্সের মত লরেন্সের রচনাবলীও তার ব্যক্তিজীবনের সহিত অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কাহিনীভিত্তিক এবং চরিত্র ও বিশ্লেষণপ্রধান যে উপন্যাস কনরাড, ফরস্টার ও লরেন্স এই তিনজন মধ্যাবলম্বী ঔপন্যাসিকগণ লিখেছিলেন তাই ইংরেজি উপন্যাসের মূলধারা। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, লরেন্স আধুনিক কালের বিমাবিকীকরণের প্রভাব এবং শিল্পায়নের প্রক্রিয়াতে মনোনিবেশ করেন।

ডি এইচ লরেন্সের জীবন ও কর্ম

ডেভিড হারবার্ট লরেন্স বা ডি এইচ লরেন্স ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫ তারিখে ইস্টউড, নটিংহ্যামশায়ার ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২ মার্চ, ১৯৩০ তারিখে ফ্রান্সের ভেন্সে মারা যান। লরেন্সের পিতা ছিলেন এক দরিদ্র এবং উদ্দামপ্রকৃতির খনিমজুর এবং তার মাতা ছিলেন এক সংস্কৃতিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চাভিলাষসম্পন্ন মহিলা। দারিদ্র্যনিপীড়িত ক্লেদাক্ত পরিবেশের মধ্যে পারিবারিক মন-কষাকষি ও কলহের ভিতর দিয়েই লরেন্সের বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়। লরেন্সের উপন্যাসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈসাদৃশ্য ও মনের অমিলে আমরা লরেন্সের এই বাল্য অভিজ্ঞতার ছাপই পাই। মাতার আপ্রাণ চেষ্টা ও আত্মনিগ্রহের ফলেই লরেন্স কিছুটা শিক্ষালাভ করেন এবং শিক্ষকতা করবার যোগ্যতা অর্জন করেন। লেখাকে পুরাপুরি বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করবার পূর্বে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

ডি এইচ লরেন্সের রচিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর নাম সন্স অ্যান্ড লাভার্স, দ্য রেইনবো, উইমেন ইন লাভ, লেডি চ্যাটারলিজ লাভার, জন টমাস অ্যান্ড লেডি জেন​। ডি এইচ লরেন্সের রচিত গল্প গ্রন্থগুলো হচ্ছে উড অফ ক্রিসেন্থিমামস, দ্য ভার্জিন অ্যান্ড দ্য জিপসি, এবং দ্য রকিং-হর্স উইনার ইত্যাদি।

ডি এইচ লরেন্স রচিত উপন্যাসসমূহের আলোচনা

লরেন্সের প্রথম বিখ্যাত, এবং অনেকের মতে সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস সন্স অ্যান্ড লাভার্স-এ শুধু তার নিজের ব্যক্তিজীবন নয়, গোটা পারিবারিক জীবনটাই ছায়া পড়েছে। এই উপন্যাসের নায়ক পল মোরেলকে তার মাতা তার পিতার উদ্দামতা হইতে সযত্নে বাঁচিয়ে মানুষ করিয়া তোলেন। ছেলেকে ঘিরেই মাতার জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্খা। পুত্র কিন্তু মাতৃস্নেহের এই গভীরতা উপলব্ধি করে, প্রাণপণে তার মর্যাদা দিবার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে পুলকিত হলেও এবং নিজেকে চরিতার্থ অনুভব করলেও কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভব করে। পরে মিরিয়ম নামক এক আদর্শবাদী, কল্পনা-বিলাসিনী রমণীর সংস্পর্শে এসে সে যেন খানিকটা সার্থকতা লাভ করে এবং ইহাকে উপলক্ষ করে তার সাথে তার মাতার মনোমালিন্য হয়। কিন্তু মিরিয়মও পলের চিত্তের শূন্যতা ভরাতে পারে না এবং পল ক্লারা নামে এক বিবাহিত তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত মিরিয়ম ও ক্লারা কর্তৃক পরিত্যক্ত হবার পর পলের চৈতন্যাদয় হয়—সে যেন উপলব্ধি করতে পারে যে, মানুষে মানুষে পূর্ণ মিলন কখনই সম্ভবপর নয়; শরীরের পূর্ণ মিলনের পরও যা বাকি থাকে তা মানুষের অলভ্য। আত্মোপলব্ধিই শেষ কথা। ইন্দ্রিয়তৃপ্তির মধ্য দিয়া নিবৃত্তি ও মোক্ষলাভ-তন্ত্রের এই মতবাদ যেন লরেন্সের লেখার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে।

পিয়ানো কবিতাটি সম্পর্কে অনুপ সাদির একটি আলোচনা দেখুন ইউটিউব থেকে নিচে ক্লিক করে

ডি এইচ লরেন্সের পিয়ানো কবিতার আলোচনা

লরেন্সের আরেকটি উপন্যাস The Rainbow বা রামধনু অশ্লীলতার দায়ে বাজেয়াপ্ত হয়; আর একখানি Women in Love বা প্রেমাতুরাদের কাহিনী বাজেয়াপ্ত না হলেও তীব্র বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয় এবং অপর একখানি Lady Chatterley’s Lover বা লেডী চ্যাটার্লির প্রেমিক তো ইংল্যান্ডে মুদ্রিত হবারই সুযোগ পায়নি। এই উপন্যাসখানি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সে প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থকারের মৃত্যুর অনেক পরে, মাত্র ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে, আইনসঙ্গতভাবে ইংল্যান্ডে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে প্রবেশ করবার অধিকার পায়। সেদিনের রুচিবোধের নিরিখে লরেন্সের উপন্যাসে যৌন আবেগ ও আকর্ষণের কিছুটা বাড়াবাড়ি আছে, একথা ঠিক; একথাও ঠিক যে ফ্রয়েডের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে তিনি যৌন আবেগের সর্বব্যাপিত্ব সম্বন্ধেও খানিকটা বাতিকগ্রস্ত; কিন্তু তবুও একথা স্বীকার করতে হবে যে, তার লেখা বাস্তবধর্মী এবং অশ্লীলতা দোষদুষ্ট নয়। তার উদ্দেশ্য সুগভীর এবং অকপট আত্মানুসন্ধান, রুচিবিকার পরিবেশন নয়।

সূর্যচন্দ্র, গ্রহতারা, পৃথিবী, পৃথিবীর অরণ্য, পর্বত, নদী, পশুপক্ষী, মানুষ সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা যোগসূত্র আছে—এই বোধ লরেন্সের প্রায় সব লেখাতেই পরিব্যাপ্ত হয়েছে; যৌনআকর্যণ এই যোগসূত্রের একটিমাত্র সুতা, যদিও এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সুতাটি বশে আনতে না পারিলে সমস্ত বিশ্বতত্ত্বই আমাদের নিকট অজানা থেকে যাবে—এটাই যেন লরেন্সের উপন্যাসাবলীর অঘোষিত বাণী। 

তিনি শেষ বছরগুলি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে কাটিয়েছিলেন এবং সেটিকে “বন্য তীর্থযাত্রা” নামে অভিহিত করেছিলেন। তার এই স্বেচ্ছা নির্বাসনে তিনি অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং ফ্রান্সের মতো জায়গায় গিয়েছিলেন। লরেন্সের সর্বজনীন খ্যাতি সত্ত্বেও মৃত্যুর সময় ই. এম. ফরস্টার বলেছিলেন যে যে তিনি তাদের সময়ের “সর্বকালের সবচেয়ে বড় কাল্পনিক ঔপন্যাসিক” ছিলেন।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ৮ জুলাই ২০২০, “ডি এইচ লরেন্স ইংরেজ কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক এবং প্রাবন্ধিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/d-h-lawrence/
২. কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী, কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ডিসেম্বর ১৯৬৭, পৃষ্ঠা ২৬১-২৬৩।

রচনাকাল: ৮ জুলাই ২০২০, দক্ষিণখান, ঢাকা।  

Leave a Comment

error: Content is protected !!