আমাদের জীবনে আলোকদীপ্ত শাহেরা খাতুনের অবদান

আমাদের জীবনে আমাদের মা আলোকদীপ্ত শাহেরা খাতুনের অবদান আলোচনা করবার উদ্দেশ্যে এই এই লেখা লিখতে বসেছি। তাঁর অবদান বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। আমাদের মা শাহেরা খাতুনের জীবন কঠোর অবরোধ প্রথা এবং পুরুষাধিপত্যের পরিবেশে অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিরাজিত বহুমুখী কাজের বৈশিষ্ট্য ছিল পুরুষতন্ত্রের কঠোর অবরোধ প্রথার উচ্ছেদ করে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে নারী পুরুষের সমতা বিধান করা। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও নিজ চেষ্টা, সাধনা ও একাগ্রতা দিয়ে তিনি নারী জাগরণে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য থেকে এলাকায় কাজ করেছেন।

শাহেরা খাতুন কলহ বিবাদমুক্ত শিক্ষিত পরিবার গঠন করেছেন। মা হিসেবে তিনি সন্তানদের জ্ঞানের জগতকে সম্প্রসারিত করতে সব সময় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আমাদের সাফল্য অর্জনে গর্বে তার বুক ভরে উঠতো। ছোট সন্তান অনুপ সাদিকে এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডের অধীনে ১৩ তম মেধা তালিকা অর্জনে সহায়তা করেছেন। এই পরিবারের তিন জন সদস্য সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত থেকে লেখক ও অধ্যাপক হিসেবে সারা দেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই পরিবারে সদস্যরা প্রায় ৩০ খানা পাঠ্য ও সৃজনশীল বই এর লেখক ও সম্পাদক। দেশ বিদেশে এই বইগুলির যথেষ্ট চাহিদা ও সুনাম রয়েছে।

শাহেরা খাতুন সামাজিক সমস্যা বা ব্যধিসমূহকে দূর করার চেষ্টা করতেন। তিনি নারী পুরুষের বৈষম্যের বিপক্ষে সর্বদায় কাজ করতেন। সর্বদাই তিনি ছিলেন যৌতুক বিরোধী। প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বদায় তিনি ছিলেন সোচ্চার। নেশাখোর, ঠক, বাটপারদের তিনি সুপথে আনার চেষ্টা করতেন। হিংসা, বিদ্বেষ, জোর, জুলুম, শোষণ, বঞ্ছনা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন খারাবি ও নির্যাতন প্রতিরোধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। দাম্পত্য কলহ থেকে অসংখ্য পরিবারকে তিনি রক্ষা করেছেন। তাঁর পরিবারের কেউ কোনোদিন নেশা ও মাদকদ্রব্য স্পর্শ করেন নি।

শাহেরা খাতুন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষাকে সুন্দর জীবনের প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পরিবারের কাছে শিক্ষার আলোকবর্তিকা। আনন্দ বৃদ্ধি ও বেদনা বিলোপের শিক্ষাই তিনি সকলকে দিয়ে গেছেন। চার সন্তানের তিনজনকে যুদ্ধ বিধস্ত ও দুর্ভিক্ষের সময় ঝড়ে পড়া অবস্থা কাটিয়ে পুনরায় আলোর পথ দেখিয়েছেন। তখন কৃষিতে হাইব্রিড পদ্ধতি ছিল না। আগাছা ও কীট দূরীকরণের উপায়ও উন্নত ছিল না। ফলে পরিশ্রম অনুযায়ী ফল না ফলে দুর্ভোগ বেশি হতো।

মাকে মোটা জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এক রঙা কাপড় ও মোটা কাপড় পড়তে দেখেছি। বাসার শ্রমিকের প্রচুর খাদ্যের যোগান দিতে দেখেছি। সরিষার তৈল ভাঙ্গাতেন কলুর মাধ্যমে, বেকারী আইটেম, ফলমূল ও মুদির দোকানে বাবা ও আমাদেরকে সহযোগিতা করতেন। তখন বিদ্যুত ছিল না। হাত পাখা ও কাঁথা মোড়ানো লাঠির দুপাশে ঝুলানো রশিতে সারা রাত ঘুমের সময়ও বাতাস দিতে পারতেন। দেখতাম ঘুমের ঘোরে বাতাস করে চলেছেন।

আমার বড় ভাই লুতফরের ভাগ্যে কিছুটা আদর যত্ন মিললেও বাকীদের বড়রাই দেখভাল করতেন। ব্যবসা ও কৃষি কাজের চাপে মা বাবা সন্তানদের আদর যত্ন তেমন একটা করার সময় পেতেন না। দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক বন্ধন বা সম্পদের মালিকানার দালিলিক মালিকানার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না। চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় নয় ভাই বোনের মধ্যে মাত্র চার জন চল্লিশ বছর বয়স অতিক্রম করার সুযোগ পেয়েছি। বাকীরা শিশু বা কিশোর বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছে।

পাকিস্তান আমলে বেকারী আইটেম ও প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ায় ভাই বোনদের দাঁতের ক্ষয় রোগ বা মাড়ির সমস্যার মতো অসচেতনতা বা ব্যস্ততার কারণে দেখভালের অভাব ছিল। মা বাবা ও আমরা সবাই বি পজেটিভ রক্তধারী। শুনেছি বি রক্তের গ্রুপের লোকেরা কর্মে বিশ্বাসী হয়। আমার মা বাবা কর্ম করেছেন খুব বেশি কিন্তু নিজেরা ফল ভোগ করবার বিষয়ে উদগ্রীব ছিলেন না, ফলে ফলভোগী হয়েছে অন্যরা।

মা শাহেরা খাতুন ভাইদের উচ্চ শিক্ষিত হতে দেখে শিক্ষার প্রতি খুবই আগ্রহী ও সচেতন ছিলেন। বাড়িতে বৈঠকখানা ও মসজিদ দেখেছি ছোটবেলা থেকে। বৈঠক খানায় লজিং থাকতেন স্কুল কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদে লজিং থাকতেন মাদ্রাসার কামেল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের কাছ থেকেই আমি উর্দু, ফার্সী ও আরবী থেকে ধর্ম ও তুলনামূলক ধর্ম সম্বন্ধে অনেক ধারণা লাভ করেছি। আমার ধর্মদর্শন গ্রন্থ লেখার ভিত্তি রচিত হয়েছিল সে সময়। লজিংদের খাওয়া সরবরাহের দায়িত্ব আমার উপর থাকায় আমি বাড়তি আদর ও শিক্ষা পেতাম।

আমি লেখাপড়া করতাম বিধায় ব্যবসা ও কৃষি কাজের যথেষ্ট ক্ষতি হতো। একারণে একবার আব্বা বইগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। পরবর্তীতে মা ও বাবা আলোচনা করে কৃষি অপেক্ষা লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে উভয়েই তাঁদের ভুলকে দ্রুত শুধরে ফেলেন। হলদিবাড়ী, কাদোর কান্টা ও খিলবাহারের মতো জমিগুলো মা ও আব্বা বিক্রি করেছেন আমার এসএসসি ও এইচএসি ফর্ম ফিলাপের জন্য।

মায়ের বিবাহের সময় পেয়েছিলেন প্রচুর স্বর্ণ ও রূপার গয়না। মাঝে মধ্যে রোদে শুকাতে দিতেন একটা বড় বেতের আড়িতে করে। আমরা এই গয়না নিয়ে খেলতাম। এত সাধের গয়না তিনি যুদ্ধের আপদ কালীন ও দুর্ভিক্ষের সময় সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে বিক্রি করে আমাদের খাওয়া ও পরার ব্যবস্থা করেছেন। শৈশবে আমাদের ভালো লেখাপড়ার জন্য আশে পাশের স্কুল ও মাদ্রাসার সমস্ত শিক্ষককে মাঝে মধ্যে ডেকে এনে দুধ, চিতাই, ফল মূল, ক্ষীর ও মাংশ পোলাও খাওয়াতেন। নাতী ও নাতনিদের শিক্ষার ব্যাপারেও অকাতরে টাকা পয়সা খরচ করে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য এনজিও ও সমিতি থেকে ঋণ তুলে দিতেন। সবারই উচ্চ শিক্ষার জন্য মা তাঁর সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই পঞ্চম থেকে এসএসসির ব্যাচ বাসায় পড়িয়েছি। আম্মা আমার শিক্ষার্থীদের যত্নের প্রতি খেয়াল রাখতেন।

মেজ ভাই বানী ইসরাইল একবার রাগ করে না বলে বাড়ি থেকে চলে যায় এবং দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে টালী তৈরির কারখানায় কাজ নেয়। এই ঘটনাটিও আমাদের পারিবারিক জীবনে বেশ কিছু বেদনা তৈরি করে। সেই সময় মাবাবার কান্নার চাপে মেজ ভাইয়ের খোঁজ করেছি বেশ কিছু জায়গায়, তখন সন্তান হারানো মা বাবার শরীর ও মন ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে প্রাণপণে চেষ্টা করতেন শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করতে। এইচএসি পরীক্ষা দিয়ে মাত্র ৩০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসি। মা বাবা অতি কষ্টে দু এক শত বা তার অধিক টাকা মানি অর্ডার করে মাঝে মধ্যে পাঠাতেন। ঢাকায় পড়ালেখা করতে তা অতি সামান্য হলেও তাতেই তাদের আশীর্বাদ মিশ্রিত থাকত।

কোচিং এবং প্রাইভেট পড়িয়েই নিজের শিক্ষা ও জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করতাম। কিন্তু পরীক্ষা শেষে টিউশনি থাকতো না। তখন মাবাবার সহযোগিতা ছাড়া চলা কষ্টকর হতো। আমার মনে হয়, সবাইকে শিক্ষিত করতে হলে আত্মীয়দের যার যার অবস্থান থেকে যতটুকু সাধ্য করা দরকার বা আয় রোজগারের ছোট একটা অংশ ব্যয় করা একান্ত দরকার। আমার মা সারা জীবন এরকম সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।  

চাকুরীর আগে মা বাবাকে কোনদিন ঢাকায় নিয়ে আসতে পারি নাই। আব্বার মৃত্যুর কিছুদিন পরে মা প্রথম আজিমপুরের বাসায় আসেন। ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চাকুরি করেছি একাকী। দীর্ঘ এক যুগ পরে মায়ের পীড়াপীড়ি ও জন্ডিসে ভোগার পর বিয়ে করেছি। ২০০৪ হতে ২০১৪ পর্যন্ত দশ বছর ঢাকার বাইরে নরসিংদী ও চাঁদপুর সরকরি কলেজে থাকাকালে আমার সাথে এক দু মাস করে মা থাকতেন। যেহেতু বিবাহিত জীবনে মা ও শাশুড়িকে এক সাথে নিয়ে থাকতে হয়েছে। তাই মা ২০১৫ হতে ২০২১ পর্যন্ত আমার কছে বেশি দিন থাকতেন না।

করোনাকালের আগে থেকেই ভাই, ভাগ্নে, ভাতিজী ও নিজের স্বাচ্ছন্দের জন্য আলাদা বাসায় থেকেও মাকে বেশিদিন ঢাকার বাসায় ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। তিনি তার স্বভাসুলভ চিরাচরিত নিয়মে গ্রামে ফিরে যেতেন। সেখানে একাকিত্ব জীবন যাপন করতেন। করোনাকালে যাতায়াত বন্ধ থাকায় হাসপাতালে নিয়ে তেমন ভালোভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় নি। এ সময়ে গ্রমের বাড়ির রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটার ফলে পায়ে আঘাত পেয়ে আহত হন। ঢাকায় বিশেষায়িত হাসপাতালে অর্থোপেডিক ডাক্তারের চিকিৎসায় হাড় ক্ষয় রোগ ধরা পড়ে এবং চিকিৎসা করানো হয়। কানের শ্রবণশক্তিরও চিকিৎসা করা হয়।

মায়ের আর্থাইটিস রোগে হাঁটতে চলতে অসুবিধা হতো। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো ২০২১ সালের মে জুন মাসে নিজ এলাকার হাসপাতালে একরূপ একাই চিকিৎসা নিতেন। ঢাকায় একদিনের জন্য থাকতে চাইতেন না। শেষ পর্যন্ত ২ জুন ২০২১ তারিখে রাণীশংকৈল হাসপাতালে উচ্চ রক্তচাপ থাকা অবস্থায় এক ব্যাগ রক্ত ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে দিতে গিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।

আগামী ২ জুন তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার নামে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হবে জেনে এই স্মৃতি চারণমূলক লেখা এবং সকলে মিলে এই উদ্যোগ গ্রহণ করায় সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই স্মারক গ্রন্থটি নিশ্চয় সকলকে কিছুটা হলেও স্বস্তি, আনন্দ ও উপকৃত করবে এবং আমাদের জীবন সার্থক হবে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!