আমার দাদী শাহেরা খাতুন সারা জীবন গ্রামে বসবাস করেছেন। গ্রামে যত রকমের কাজ আছে, তিনি সেসব কাজ খুব সহজেই সুন্দরভাবে দক্ষতার সাথে করতে পারতেন। আমার দাদী সবচেয়ে সুন্দর ভাবে পারতেন কাঁথা সেলাই করতে। এই কাজ তিনি সারা জীবন করেছেন ভালোবেসে, এমনকি মরার আগ পর্যন্ত করেছেন। চোখের ছানি অপারেশন হবার পরে আবার কাঁথা সেলাই করা শুরু করেন। আমি দাদীর কাছেই কাঁথা সেলাই করা শিখেছি। ২০০৭ সালের দিকে আমি দাদীর কাছে কাঁথা সেলাই করা শিখতে শুরু করি। তিনি যত্নের সাথে আমাকে কবুতরখোপী, ভাঙ্গাফোড় ও বিস্কিটফুলী কাঁথা সেলাই করতে শিখিয়েছেন। কাঁথা সেলাই করা শিখতে আমার ২০১০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
আমার দাদী আমাকে হাঁস, মুরগি, ছাগল ও গরু পালন করা শিখিয়েছিলেন। তিনি নিজেও হাঁস, মুরগি ও ছাগল পালন করতে পছন্দ করতেন। আমি তাঁকে মাত্র একটি গরু পালন করতে দেখেছি, ঐ গরুটার চারটি বাছুর হয়েছিল। ছাগল পালন করেছেন সব বছরই, তবে সেই ছাগল পালন করা হতো কুরবানীর জন্য। ছাগল কখনো বিক্রির জন্য পালন করতে দেখিনি। মুরগি পালন করা হত মূলত ডিম এবং মাংস খাবার জন্য।
আমার দাদী শাহেরা খাতুন কখনো অপব্যয় করেননি। প্রয়োজন ছাড়া কোনো খরচ করতে চাইতেন না। টাকা জমিয়ে রাখতেন মূলত আমাদের খাতা কলম কেনার জন্য বা স্কুলের বেতন দেবার জন্য। এছাড়াও টাকা বা ফসল ধার দিতেন যারা ফেরত দিতেন কেবল সেরকম মানুষকেই। যারা ছোট খাট অভাবে পড়তেন, তারপর দাদীর কাছে সহায়তা চেয়েছেন, এমন কাউকে কখনো না করেননি।
অভাবী প্রতিবেশীদেরকে ধান, চাল, অন্যান্য ফসল বা টাকা দিয়েও সাহায্য করেছেন। কোনো প্রতিবেশী ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, মাছ আলু, আলু, তিল, ম্যাস, মটরশুঁটি, রসুন, আদা, হলুদ ও মরিচের বীজ চাইলে তিনি সব সময়ই দিয়েছেন। হলুদের বাগান সব সময়েই দেখেছি এবং হলুদ সব আত্মীয়কে দিতে পছন্দ করতেন। বীজের হলদি যেমন অনেককেই দিয়েছেন তেমনি চাষ করা হলদি গুঁড়া করে দিয়েছেন।
অনেক রকম ফসলের বীজ তার কাছে সব সময়ই পাওয়া যেত। কোন ফসল বাংলা কোন মাসে পাকবে সেইটা তিনি জানতেন। যেমন আতা ফল কোন সিজনে পাকে এইটা আমি মনে রাখতে পারি না, কিন্তু আমার দাদী সব ফল কোন মাসে ফুল হবে, কোন তারিখে পাকা শুরু হবে তা বলতে পারতেন।
তার বাগানে কাঁঠাল, আম, লিচু, কলা, জাম, ডালিম, পেয়ারা, বরই, মেহেদী, লেবু, পেপে, ডেউয়া, জাম্বুরা, গাব, নিম, তেঁতুল, জীবন, শিমুল ইত্যাদি গাছ ছিল। আকাশী মরিচ, সাদা মরিচ, মাছ আলু, গোড়া লেবু, কাঠ শিম এবং আনারসের বাগান সব সময়েই দেখেছি। মিষ্টি আলু, পুঁইশাক এবং সাজনা গাছের পাতা শাক খাওয়ার জন্য সব সময়েই থাকত।
ফসল চাষ করার সময় খুব অল্প জায়গাতে স্থান নির্ধারণ করে করতে পারতেন। অল্প জায়গায় চাষ করার করার কারণে সেচ দিতে তেমন কষ্ট করতে হত না। বয়স বেড়ে গেলে তিনি পরিশ্রম করতে কম পারলেও বালতি দিয়ে পানি দিতেন।
আমার দাদী দুধ ছাড়া রান্না করা ক্ষীর, আন্ধাসা, মতিচুরের লাড়ু, বাতাসা, কিশমিশ খেতে পছন্দ করতেন। গোল মরিচ এবং আদা এবং গুড় দিয়ে ঝাল রান্না করে খেতে খুব পছন্দ করতেন। শাক খুব ভাল রান্না করতে পারতেন, কিন্তু খেতে পছন্দ করতেন না। কেবল সজনা পাতার সোডা দিয়ে সিদ্ধ করে এক ধরনের ঘাঁটি রান্না করতেন, দেখতে সবুজ রং হত, খেতে খুব মজা হত এবং তিনি খেতে খুব ভালবাসতেন। টাকি, শোল এবং সিলভার কার্প মাছ খেতে পছন্দ করতেন, ইলিশ মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন, এবং সবাই বোয়াল মাছ পছন্দ করার কারণে তিনি বোয়াল মাছ বাড়িতে আসলে খুশি হতেন।
তিনি রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে ধাঁধাঁ বলতেন। প্রায় মনে করে বলতেন ‘এক টুকি গাছে, লাল পেয়াদা নাচে’, ‘ঢেউয়ের উপর ঢেউ, তার উপর বসে আছে লাট সাহেবের বউ’, ‘দল পিপি দল পিপি দলে নাই বাসা, ঘর নাই দুয়ার নাই, মানুষ খাওয়ার আশা’, ‘বনে থেকে বারাইলো টিয়া, লাল টোপর মাথায় দিয়া’, ‘ওহি ডাণ্ডা লাকা লাকা পাত, ওহি ডান্ডা সাড়ে ষোল হাত’, ‘একটুকি মেনি গাই, ঘাটে ঘাটে পানি খাই’, ‘কোন কোন গাছে সাজন সাজে, কোন কোন গাছে বাজন বাজে, কোন কোন গাছে ছেঁড়া কাঁথা, কোন কোন গাছে মরার মাথা’, ‘হকর হকর তুলে মাটি, ছয় চোখ তিন পুটকি’ – এই রকম অনেক ধাঁধাঁ। উপরের যে কয়েকটি ধাঁধাঁ আমার মনে আছে সেগুলোর উত্তর হচ্ছে যথাক্রমে মরিচ, কচুরিপানা, জোঁক, পেয়াজ, আঁখ, বড়শি, শিমুল-কড়াই-কলা-বেল গাছ এবং লাঙল দুই গরু আর মানুষ। তার আরো অনেক ধাঁধাঁ মনে ছিল, কিন্তু আমি ভুলে গেছি।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।