বিনোদিনী দাসী উনিশ শতকের জনপ্রিয়, দক্ষ, শক্তিশালী ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লড়ায় করে গড়ে ওঠা অভিনেত্রী। তিনি যখন থিয়েটারে আসেন সেই সময় পুরুষেরা নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতো। বিনোদিনী নিজের অবস্থান তৈরির জন্য সামন্তীয় সমাজের নানা প্রতিবন্ধকাতাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছেন। নিজের অধিকারের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বারা বারবার ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন কিন্তু হার মানেন নি। শৈশব থেকেই তিনি দেখেছেন স্বপ্নগুলোর সস্তায় বিকিয়ে যাওয়া। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বাঁচার এবং নাট্যমঞ্চসহ সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
বিনোদিনী দাসী-র বাল্যজীবন
বিনোদিনী দাসীর জন্ম ১৮৬৩ সালে। মাত্র পাঁচ বছরের বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু সংসার করা হয় নি তাঁর। ছোটবেলা থেকে প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নিজেকে তৈরি করতে থাকেন নিজেকে। গঙ্গাবাঈের কাছে গানের তালিম নেন। শৈশব থেকেই শিল্পী জীবনে পদার্পন করেন। এরপরে তাঁর সাথে বিভিন্ন গানের আসরে যেতেন। সেই সময় তিনি মঞ্চের সাথে পরিচিত হতে থাকেন। গঙ্গাবাঈ বুঝতে পারেন বিনোদীনির অভিনয়ের প্রতি অনুরাগ আছে।
মঞ্চ অভিনয় জীবন
১৮৭৪ সালে ১২ বছর বয়সে শ্রী ব্রজনাথ শেঠ এবং পুর্নচন্দ্র মুখপাধ্যায়ের মাধ্যমেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনয় জগতে আসেন। এই দুইজন নাট্যবিশেষজ্ঞ বিনোদিনীর মধ্যে দেখেছিলেন শিল্পের প্রতি অনুরাগ ও এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে। সেইসময় বিনোদিনী ১০ টাকা বেতনে যোগ দেন ভুবন মোহন নিয়োগীর গ্রেট ন্যশনাল থিয়েটারে। সেই সময় ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ শুরু করেন ও নাটক করতে থাকেন। সেই থিয়েটারে ছয় বছর কাজ করেন। পাশাপাশি বেঙ্গল থিয়েটারে কিছু কাজ করেন। সেই থিয়েটারে ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ; পরবর্তিতে তাঁরা দু’জন মিলে ১৮৮৩ সালে স্টার থিয়েটার গড়ে তোলেন। গিরিশচন্দ্র ছিলেন সেই সময়ে একজন উচুমানের অভিনেতা। গিরিশচন্দ্রকে নিজের গুরু হিসাবে উপস্থাপন করেছেন বিনোদিনী নিজের আত্নজীবনীতেই।[১]
সেই সময় বিনোদিনী যে অবস্থান থেকে উঠে এসেছিলেন ঠিক একই জায়গা থেকে আরও দুজন অভিনেত্রী এসেছিলেন কিরনবালা ও তিনকড়ি দাসী। এই তিনজনই একই গুরুর ছাত্র। তিনজনই অসাধারণ অভিনয় করতেন। জীবন সংগ্রাম একই। পরিবার, সমাজ, থিয়েটারের লোকজনের কাছ থেকে নানা অপমান, বঞ্চনার, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কি ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাঁর একটা ছোট উদাহারন – তিনকড়ি দাসী যখন মঞ্চে কাজ করতেন তখন চল্লিশ টাকা বেতন পেতেন। সেইসময় এক ধনী ব্যক্তি দু’শত টাকা দিয়ে রক্ষিতা হিসাবে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনকড়ি এই প্রস্তাবে রাজি হন না। এজন্য তাঁর মা তাকে বাঁশের বাখারি দিয়ে মারধর করে। তিনদিন জ্বরে পরে ছিলেন কিন্তু অভিনয় জগতেই ছিলেন অনেকটা সময়।[২]
এইরকম নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন নাট্যকর্মীরা। বিনোদিনী ছিলেন শক্তিশালী অভিনেত্রী তাই পারিবারিক ও সমাজ থেকে পাওয়া বঞ্চনা তাঁকে কাতর করতে পারেনি। একটা সময় পর্যন্ত তিনি তাঁর সকল সহকর্মীদের কাছে পেয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনীতি, ব্যক্তিমালিকানা, স্বত্বাধিকারের ক্ষেত্রে অনেক স্বার্থপরদের দেখা যায়। সঙ্কটের সময় বন্ধুর মুখোশে থাকা শত্রুদের চেনা যায়। ঠিক এমনটাই ঘটেছিলো বিনোদিনীর ক্ষেত্রেও। নিজের নামের যখন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো সেই সময় বিপক্ষে দাঁড়ায় সহকর্মীরা। কিন্তু থিয়েটারের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলো বিনোদিনী। সেসময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচোখের কাছে নত শিকার করে গিরিশচন্দ্রও বিনোদিনীর পক্ষে থাকতে পারেন নি। অথচ এই গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীকে বিশ্বের নাট্যমঞ্চের জন্য যোগ্য অভিনেত্রীতে তৈরি করেছিলেন।[৩]
খ্যাতি ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে লড়ায়
অভিনয় করে যে অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন তা দিয়ে বিনোদিনী দাসী চেয়েছিলেন নিজের নামে একটি থিয়েটার করতে। সেই চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তিনি অভিনয় জগতে যেভাবে খ্যাতি পেয়েছিলে, পত্র-পত্রিকায় যেমনটা লেখা লেখি হয়েছিলো তাঁর সম্পর্কে সেটা তাঁর পরিচিতির জন্য যথেষ্ট। তাঁর অভিনয় দেখতে এসে বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দসহ অনেক জ্ঞানীগুণীরা প্রশংসা করেছেন।[১] এইসব জায়গা থেকে বিশ্লেষণ করে যদি মনে করা হয় তাঁর নামে থিয়েটার করা সেইসময় উচিৎ ছিলো বা প্রযোজন ছিলো তাহলে সেটা ভুল হবে। যেই গিরিশচন্দ্রকে তিনি গুরু মান্য করেছে, যার অভিনয়, পান্ডিত্যকে শ্রদ্ধা করেছিলেন। তিনিও যখন নতুন থিয়েটার তৈরি করেন সেটা কিন্তু নিজের নামে করেন নি। অথচ গিরিশচন্দ্র ছিলেন বাঙালি সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক। তিনি চাইলেই সহজে নিজের নামেই থিয়েটারের নাম দিতে পারতেন। এটাকে বিশ্লেষণ করতে হবে তখনকার সমাজটাকে বুঝে। সেই সময় পাবলিক কি চাইতো? কোনো ব্যক্তি নামের থিয়েটার কি তেমন পরিচিত হতো বা কোনো মেয়ের নামে একটা থিয়েটার সমাজ মেনে নিতো কি না। এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তো আছে। বর্তমানে আমরা বেশ কিছু অভিনেত্রীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হই। যেমন অপি করিম, জয়া হাসান ইত্যাদি। তাঁদের নিজের নামে একটা থিয়েটারকেও তো মেনে নিতে কষ্ট হবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। এমনও নজির আছে কোনো নারী নিজের নামে কোন স্কুল করেছে তাঁর মারা যাবার পরে এই স্কুলের নাম বদলে গিয়েছে। এখনকার সময়ে যেটা মানতে কষ্ট হয় সমাজের আর সেই সময় নারী হয়ে মঞ্চে অভিনয় করাটাই ছিলো যুদ্ধ। এক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বুজতে হবে।
আরেকটা ব্যাপার আছে। ব্যক্তি যা চায় সেটার জন্য তাঁর মাঝে কতটুকু তাড়না আছে সেটা বুঝা। যেমন আমরা সবাই স্বাধীনতা চাই কিন্তু এই স্বাধীনতার জন্য যে কিছু কাজও করতে হয়। সেটা যদি কেউ না করে মনে করে অন্যজন তাকে বুঝবে ও স্বাধীনতা দিবে তাহলে সেটা ভুল হবে। আমরা বেগম রোকেয়ার উদাহারন দিতে পারি। তিনি চেয়েছিলেন নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সে জন্য অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন, স্থান পরিবর্তন করেছেন, কাজ চালিয়ে গিয়েছেন এবং অনেকটাই সফল হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি যেই অবস্থান থেকেই উঠে আসুক না কেনো নিজের লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি ঠিক থাকলে অনেকটা এগোনো যাবে। এর জীবন যুদ্ধে রোকেয়া ও বিনোদিনী দুজনেই ছিলেন লড়াকু। তবে বিনোদিনী ছিলেন অভিমানী, সমাজ বিশ্লেষনে রোকেয়ার মতো দক্ষ নন।
বর্তমান সময়ে থিয়েটারে বিনোদিনী দাসী-র প্রভাব
অনেকে প্রশ্ন করতে পারে থিয়েটার ও সহকর্মীদের কাছে থেকে বিনোদিনী তাঁর পাওনা কি পেয়েছেন? এই প্রশ্ন যদি আমাকে করা হয় সেক্ষেত্রে আমাকে যেটা ভাবতে হবে, আমি যা চাচ্ছি সেটা সম্পর্কে আমি কতটুকু সচেতন। এছাড়া প্রতিভা এমন জিনিস সেটা চাপা থাকে না। যেমন ধরুন আমি লেখা লেখি করি। এই জায়গাতে যদি কেউ মনে করে আমার লেখাগুলো আসলে আমি নিজে লিখি না অন্য কেউ সেটা করে দেয় বা আমি কপি করি। এমনটা মনে স্বাভাবিক কিন্তু আমার যদি যোগতা থাকে এই ক্ষেত্রে তাহলে আমার প্রতিভাই একসময় প্রতিষ্ঠিত হবে আর অন্যের ভুল চিন্তা পরাজিত হবে। তবে একটা ব্যপার খেয়াল রাখতে হবে এটা ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে; জীবনটাকে ফুটবল বানানো যাবে না। এরওর পায়ে লাথি খেয়ে অন্যের জয় নিশ্চিত করাতে ফুটবলের তো আনন্দ নেই। আমার মনে হয় বিনোদিনীর জীবন ফুটবলের মতো হয়েছিলো। যেটা সে নিজেও জানতো না। মনে করেছিলো তাঁর শ্রদ্ধের গুরু তাঁর নামে থিয়েটার করে দিবে কিন্তু তা না করায় অভিমানে নিজেকে নাট্যমঞ্চ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রথমে তিনি নিজেই নিজের সাথে অন্যায় করেছেন। নিজের যোগ্যতাকে তিনি বুঝতে পারেন নি। এরপরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর স্বাধীনতা তো চায় নি। পরবর্তিতে তিনি গান রেকর্ড করেছেন। লেখালেখি করেছেন। নিজের আত্নজীবনী বের করেছেন।
এখন কথা হলো বর্তমান মঞ্চাভিনয়ে আগ্রহী মেয়েদের কাছে বিনোদিনী, তিনকড়ি বা কিরনবালার প্রভাব কতটুকু? প্রভাব খুব সামান্য কিন্তু থিয়েটার জগতে তাঁদের অবদান ও গুরুত্ব অপরিসীম। এখনকার মেয়েদের সেই সময়ের মতো সংগ্রাম করতে হয় না। এখন যারা মঞ্চে অভিনয় করতে আসে তাঁদের অর্ধেকের বেশি টেলিভিশনে নায়িকাদের মতো নিজের মনে করে আর ফ্যাশন বুঝে। যোগ্যতা যাই থাকুক নাকেনো চাকচিক্য দেখায় বেশি। সেই সময়ে বিনোদিনীরা ব্রিটিশ শাসক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের, পরিবারকে কুপমন্ডুকতাকে উপেক্ষা করে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন তেমনটা এখন খুব কম দেখা যায়। তবে একেজনের লড়ায়টা একেক রকম। পরিবারে কাছ থেকে অনেকে সম্মতি পায় না তাই অভিনয় করতে কিছুটা বাঁধার সম্মুখীন হয়। যারা অভিনয় করতে আসে তাঁরা অভিনয়টাকে কমার্শিয়ালভাবে দেখে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটা তাঁদের কাছে পরিষ্কার না। তবে এরমধ্যেও থিয়েটারকে ভালোবেসে কিছু মানুষ কাজ করে যাদের কারণে আমরা দেশের মঞ্চে ভালো কিছু নাটক দেখতে পাই।
থিয়েটার ও রাজনীতি
অনেকেই মনে করেন থিয়েটার বা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অরাজনৈতিক। এই কথা আমি আমার রাজৈতিক, সাংস্কৃতিকজীবন ও কলেজ জীবন থেকে শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবে তা দেখেছি অন্য। অরাজনৈতিক বলে বাস্তব জগতে কোন সংগঠন আছে কি না আমার জানা নাই। তবে হ্যাঁ সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ততা নাও থাকতে পারে কিন্তু প্রতিটা সংগঠন কোনো না কোন রাজনৈতিক মতাদর্শনকে লালন করে এবং নিজের সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটায়। গিরিশচন্দ্র নতুন থিয়েটার গড়ে তুলেছিলো সেটাও ছিলো রাজনৈতিক। এক অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীর ব্যবসাতে লাভ হচ্ছে না বলে থিয়েটারে নানা চাপ ছিলো তেমনি ব্রিটিশ বিরোধী কোন নাটকে অভিনয় করার স্বাধীনতাও ছিলো না তখন। যখন কোনো সংগঠন নিজেকে অরাজনৈতিক মনে করবে তখন সেটা সেই সময়ে বিরাজমান শাসকের নিয়ন্ত্রনে চলে যাবে।
বিনোদিনী উনিশ শতকে উজ্জ্বল নক্ষত্র। বর্তমানের কাছে তাঁর কদর কম। কিন্তু নারীদের মঞ্চ জগতে কাজ করার জন্য যাদের অবদান স্মরণ করা যায় তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি অনেকের কাছে প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে প্রকাশ করেই গিয়েছেন। নিজের কথা, কাজকে লিখিত নথিপত্রে প্রকাশ করায় আমরা তাঁকে বিশ্লেষণের করার সুযোগ পাই। তিনি বন্ধুর পথে চলেছিলেন বলেই আমরা আজ সম্ভবনার স্বপ্ন দেখি।
তথ্যসূত্র:
১. দর্শন চৌধুরী: বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, পুস্তক বিপণী, কলকাতা।
২. গোলাম মুরশিদ: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া, অবসর প্রকাশন, ঢাকা।
৩. বিনোদিনী দাসী: আমার কথা, বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী, কলকাতা, নব সংস্করণ ১৩২০ বঙ্গাব্দ।
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।