বিমলপ্রতিভা দেবী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী

বিমলপ্রতিভা দেবী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছিলেন। উচ্চবংশে বিয়ে হয়েও বিপ্লবী দলে কাজ করেছেন। এজন্য কয়েকবার কারাবন্দি হতে হয়েছিল। প্রথমে কংগ্রেস রাজনীতি করেছিলেন। এরপরে ১৯৪০ সালে তা বাদ দিয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হন।

বিমলপ্রতিভা দেবী-এর জন্ম ও পরিবার

বিমলপ্রতিভা দেবী ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে কটকে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক দেশ তাদের নদীয়া জেলার কাচড়াপাড়া গ্রামে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জী, মাতা ইন্দুমতী দেবী। বিমলপ্রতিভা দেবী ধনী ও সম্রান্ত ঘরের কন্যা ও বধু। পিতা প্রবর্তক-সংঘের কর্মী ছিলেন। তার প্রভাবে তিনি শৈশবেই স্বদেশী কাজে অনুপ্রাণিত হন। তার বিবাহ হয়েছিল বিখ্যাত ধনী পরিবারে জে. সি. ব্যানাজীদের বাড়ির ডাক্তার চারুচন্দ্র ব্যানার্জীর সঙ্গে। এই গোঁড়া পরিবারকে চার দিক থেকে জড়িয়ে রেখেছিল সংস্কারের কঠিন শৃঙ্খল।

রাজনৈতিক প্রভাব

পিতার স্নেহভাজন একজন বিপ্লবী কর্মীর প্রভাবে ১৯১৮ সাল থেকে বিমলপ্রতিভা দেবী ক্রমেই বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হবার প্রেরণা লাভ করেন। ১৯২১ সালে ঊর্মিলা দেবীর নারী কর্মমন্দিরে যোগদান করে তিনি বাড়ির অজ্ঞাতসারে অসহযোগ আন্দোলনের কাজ করতে থাকেন। বাড়ির প্রচণ্ড বাধা তাকে রুদ্ধ ঘরে বন্ধ করে রাখতে পারে নি।

সাংগঠনিক কাজে যুক্ততা

১৯২৭ সালে তিনি ভারত ‘নওজোয়ান সভা’র বাংলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ‘নওজোয়ান সভা’র নিখিল ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভগৎ সিং। এই সূত্রে বাংলার বাইরের বিপ্লবীদের সঙ্গে বিমলপ্রতিভা দেবীর যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল।

১৯২৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি যা-কিছু কাজ করেছেন সবই গোপনে। কিন্তু ১৯২৮ সালে কলিকাতা কংগ্রেসের সময় তিনি খোলাখুলিভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে কাজ করতে থাকেন।

নারী সত্যাগ্রহ সমিতিতে কাজ

১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি, শান্তি দাস (কবীর) প্রভৃতি কংগ্রেস-নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ সংগঠন করেন। এবং আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করেন। বিমলপ্রতিভা দেবী নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র যুগ্ম-সম্পাদিকা ছিলেন।

১৯৩০ সালের ২২ জুন দেশবন্ধুর বার্ষিক শ্রাদ্ধতিথি দিবস পালন উপলক্ষে নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন কলেজ স্ট্রীট থেকে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত। বিমলপ্রতিভা দেবী এই বে-আইনী শোভাযাত্রা ও সভায় অংশগ্রহণ করাতে ২৬ জুন তার ছয়মাস কারাদণ্ড হয়।

বিমলপ্রতিভা দেবী-এর বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত

জেলে যাওয়ার পড়ে তিনি বিপ্লবী দলেও কাজ করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার বন্দীদের মামলা পরিচালনার জন্য তিনি জালালাবাদ খণ্ডযুদ্ধে নিহত বিপ্লবীদের ছবি বিক্রির ব্যবস্থা করে বহু অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেই অর্থ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। মামলার ব্যয়নির্বাহের জন্য দিয়েছিলেন।

১৯৩১ সালের ২ অক্টোবর তিনি মানিকতলার ডাকাতি সম্পর্কে গ্রেপ্তার হন। এ সম্পর্কে আরো গ্রেপ্তার হন ধীরেন চৌধুরী, কালীপদ রায়, নরহরি সেন প্রভৃতি। বিমলপ্রতিভা দেবী পরে মামলা থেকে মুক্তি পান এবং সেদিনই তাকে ডেটিনিউ অর্থাৎ বিনা বিচারে বন্দী করে আটক রাখে। সিউড়ি, হিজলী ও প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন তিনি। প্রায় ছয় বছর ১৯৩৮ সালে তিনি মুক্তি পান।

ইউটিউবে দেখুন আমার লেনিন তথ্যচিত্র

কংগ্রেস রাজনীতি ত্যাগ

১৯৩১ সালে ত্রিপুরা জেলায় যুব সম্মেলনে যোগদান করতে যান বিমলপ্রতিভা দেবী। সেখানেই তার সাথে প্রকৃষ্টরূপে পরিচয় হয় সেখানকার বিপ্লবী কর্মীদের। ১৯৩৮ সালে তিনি কংগ্রেসের “নিখিল ভারত বন্দীমুক্তি আন্দোলন কমিটি’র সম্পাদিকা নিযুক্ত হন। ১৯৪০ সালেই ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় কংগ্রেস সদস্যপদ ত্যাগ করে বামপন্থী আন্দোলনে যোগদান করার বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন। ঐ সালের এ.আই.সি.সি মিটিং-এর পর তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

তৃতীয়বার কারাবন্দি

১৯৪১ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজদ্রোহমূলক ইস্তাহার রাখার অভিযোগে তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং দুইবছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। কারাদণ্ড ভোগ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিরাপত্তা বন্দীরূপে আটক রাখা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৯৪৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। পরে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় তার সহযোদ্ধা ছিলেন সন্তোষকুমারী দেবী, ডঃ প্রভাবতী দাশগুপ্ত, ভারতী রঙ্গ, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, সুহাসিনী জাম্বেকর প্রমুখ। ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে তার মৃত্যু হয়।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র:

১. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ৮৬-৮৭। আইএসবিএন 978-81-85459-82-0

Leave a Comment

error: Content is protected !!