কমরেড বিকাশ ভৌমিক (ইংরেজি: Bikas Bhoumik, ১৯৪২ – ১৮ অক্টোবর, ২০১৪) ছিলেন একজন শ্রমিক নেতা এবং বিভিন্ন সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও নারীমুক্তি আন্দোলনের রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৮৮-৯২ সালে ময়মনসিংহের চর কালীবাড়ি বস্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন যেখানে কয়েক হাজার প্রলেতারিয়েতের আবাসের ব্যবস্থা করেন। এ আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি এবং তার সহযোদ্ধা কমরেড এম এ মতিন নানা রকমের পুলিসী ও এলাকার মাস্তান দ্বারা হয়রানির শিকার হন।
নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চা ২০০৪ সালের মার্চ মাসে গঠিত হয়। পরবর্তীকালে ময়মনসিংহ জেলা শাখা গঠিত হলে তিনি ময়মনসিংহ জেলার আহবায়ক নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের জেলা শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। মওলানা ভাসানী মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব বহুবার পালন করেছেন। তিনি অসংখ্য বছর ময়মনসিংহ জেলায় শহিদ সিরাজ সিকদার মৃত্যুবার্ষিকী ও মে দিবস উদযাপন কমিটির আহবায়ক ও যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ময়মনসিংহের জেলার বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও নারীমুক্তি আন্দোলন এবং ১৯৮০-এর দশকের এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[১]
জন্ম ও শৈশব
কমরেড বিকাশ ভৌমিক ১৯৪২ সালে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার পলাশকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় সিংহেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন দর্জি শ্রমিক।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া তেমন করতে না পারলেও জীবনে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা নিপীড়িত মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে কাজে লেগেছিল। তিনি শ্রমিক ও কৃষকের মুক্তির জন্য শেষ জীবনে নিরলস কাজ করেছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন প্রায় ৫০ বছর বয়স হবার পর। যেই বয়সে শিক্ষিত শয়তানেরা ঘুষ দুর্নীতি আর লুটপাটে নিমজ্জিত থাকে সেই বয়সে তিনি রাজনীতিকে গ্রহণ করেছিলেন মুক্তির মহান প্রয়োজনে। মাওবাদী আন্দোলনের এই মানুষটি জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময় শ্রমিক আর কৃষকের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন।
সংগ্রামী জীবনে বিকাশ ভৌমিক
বাংলাদেশের ময়মনসিংহের প্রবীণ রাজনীতিবিদ এই শ্রমিক নেতা বার্ধক্যে উপনীত হলেও তিনি ক্লান্ত ছিলেন না। ময়মনসিংহ শহরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, মানববন্ধনে তিনি ছিলেন অগ্রসেনা। তিনি বাংলাদেশের তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন এবং ফুলবাড়ি দিবসের মিছিল সংগঠিত করতেন। এছাড়াও ময়মনসিংহের চর কালীবাড়ি বস্তিবাসীর জীবন রক্ষা ও জান মালের উন্নতির জন্য নিরলস কাজ করেছেন। তিনি দর্জি শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। শ্রমিকগণ যে অগ্রবর্তী শ্রেণি এই সত্য মেনে তিনি তাঁদের জন্য সংগঠন গড়েছেন এবং সেইসব সংগঠনে ঐক্য ও সংগ্রামের কাজ চালিয়েছিলেন।
বিকাশ ভৌমিক শিশুদের শিক্ষার জন্য সময় দিয়েছেন এবং শিশুদেরকে যথাযথ শ্রমিক শ্রেণির জন্য নিবেদিত মানুষ হিসেবে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। নারী নিপীড়ন ও নারী নির্যাতনের নিরুদ্ধে গড়া ওঠা সকল আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাতে শ্রমিক ও কৃষক জনগণ যথাযথ সেবা পায় সেজন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি হাজার হাজার মিটিং ও জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করে জনগণকে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তিনি অতীতের শহিদ ও সংগ্রামী বিপ্লবীদের জীবনী জানা এবং সেসব জীবনকে নিজ জীবনে ধারন করার চেষ্টা করেছেন।
কমরেড বিকাশ ভৌমিক সারা জীবন ভাল কাজ করে নিজেকে শ্রমিক শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন। কমরেড বিকাশ ভৌমিক তেমনি একজন মানুষ ছিলেন যিনি সমগ্র জীবনব্যাপী ভালো কাজ করার এই কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন, শোষণ মুক্তির জন্য মার্কসবাদের ভিত্তিতে আমৃত্যু নিজেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মুক্তির রাজনীতির সংগে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। বয়স তাকে কখনো কাবু করতে পারেনি, নিপীড়ন তাকে কখনো বিচলিত করেনি। শুধুমাত্র মৃত্যুই এই মানুষটিকে চিরতরে থামিয়ে দিয়েছিল। তদুপরি আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁর জীবন প্রেরনাদায়ক হয়ে রয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি মার্কসবাদী পাঠচক্রে ২০১২-১৫ সময়কালে নিয়মিত অংশ নিতেন এবং যথাসাধ্য নিজ মতামত প্রকাশ করতেন। তিনি মতাদর্শিক বিতর্কে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করতেন। মার্কসবাদ লেনিনবাদ মাওবাদ জানা ও বোঝার জন্য তাঁর ভেতরে চেষ্টার কমতি ছিলো না। মৃত্যুর আগে নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চা ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহবায়ক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
মৃত্যুকালে বিকাশ ভৌমিক
কমরেড বিকাশ ভৌমিক ১৮ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে দুপুর ১টায় ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ মাঝিপাড়ায় পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭২ বছর। মৃত্যুর পূর্বে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাশ ময়মনসিংহের চর কালীবাড়ি বস্তিতে সন্ধ্যায় আনা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চা, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম, সিপিবি, বাসদ, বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। পরে রাতে বিকাশ ভৌমিকের লাশ কেওটখালি শ্মশানঘাটে দাহ করা হয়।
বিকাশ ভৌমিকের প্রভাব
কমরেড বিকাশ ভৌমিক স্মরণে গণমোর্চার জেলা নেতা প্রফেসর মাহমুদুল আমিন খানের সভাপতিত্বে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় ১৪ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে ময়মনসিংহ শহরের মুসলিম ইন্সটিটিউটে। নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চা ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহবায়ক, প্রবীণ বিপ্লবী কমরেড বিকাশ ভৌমিক স্মরণে ময়মনসিংহ জেলা গণমোর্চার উদ্যোগে এই শোকসভা আয়োজিত ও অনুষ্ঠিত হয়।
কমরেড বিকাশ ভৌমিক মানব মহত্বের যে উদাহরণ জনগণের সামনে রেখে যান তা বোঝা যায় মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠিত তার শোক সভায়। মুসলিম ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত শোকসভায় অতিথি হিসেবে ছিলেন গণমোর্চার জাতীয় কমিটির সভাপতি জাফর হোসেন। বক্তব্য রাখেন কৃষক মুক্তি সংগ্রামের কেন্দ্রীয় নেতা হাফিজ সরকার, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আহবায়ক ও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা তৌহিদুল ইসলাম, গণমোর্চার কেন্দ্রীয় সদস্য ইলিয়াছ হাবিব, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নেতা ও ঠাকুরগাঁয়ের বিশিষ্ট সাংবাদিক জাকির মোস্তাফিজ মিলু, শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক স্মৃতি সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য বিজন সম্মানিত, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি ও শিক্ষক অনুপ সাদি, প্রাক্তন ছাত্রনেতা রতন সম্মানিত, তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতা ফরিদুল ইসলাম ফিরোজ, প্রয়াত বিকাশ ভৌমিকের কন্যা শিউলি রানী দে, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের জেলা যুগ্ন আহবায়ক তোফাজ্জল হোসেন।
এছাড়াও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবিদের মাঝে আ ন ম খায়রুল বাশার জাহাঙ্গীর, কাজী সালাহউদ্দিন মুকুল, তপন সাহা চৌধুরী, সুশান্ত দেবনাথ খোকন, অজিত দাস প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। শোকসভায় বিকাশ ভৌমিককে নিয়ে লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন তাঁর ৮ বছরের নাতনি মন্দিরা সরকার পাতা। শোকসভা পরিচালনা করেন বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আহবায়ক ও গণমোর্চার নেতা আবুবকর সিদ্দিক রুমেল।[২]
তথ্যসূত্র ও টিকা
১. অনুপ সাদি, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, “কমরেড বিকাশ ভৌমিক ছিলেন নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার সাম্যবাদী নেতা”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/bikash-voumik/
২. তাঁর মৃত্যুর খবরটি প্রকাশের তারিখ ১৮ অক্টোবর, ২০১৪ এবং তাঁর শোকসভার খবর প্রকাশের তারিখ ১৪ নভেম্বর, ২০১৪, প্রাণকাকলিতে। এখানে দুটোকে একত্রিত করে তাঁর জীবন সম্পর্কে একটি লেখা তৈরি করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।