ভূপেশ গুপ্ত ছিলেন বাংলা ও ভারতের সুবিধাবাদী সংশোধনবাদী নেতা

ভূপেশ গুপ্ত (ইংরেজি: Bhupesh Gupta, ২০ অক্টোবর, ১৯১৪ – ৬ আগস্ট, ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের বামপন্থী সুবিধাবাদী সংশোধনবাদী অন্যতম নেতা এবং বিশিষ্ট সাংসদ। তিনি— কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কি সংসদীয় ক্ষেত্রে ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষতম নেতৃত্বের অন্যতম একজন সুবিধাবাদী কমরেড।

ভূপেশ গুপ্ত অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী নেতা সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের সান্নিধ্যে এসে জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। এরপর বিদেশে রজনীপাম দত্ত’র সংস্পর্শে এসে আন্তর্জাতিকতাবাদী সুবিধাবাদী বামপন্থী রাজনীতির শিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেমের বোধে উদ্দীপিত হয়ে সমাজতন্ত্রের নামে সংসদে যাবার পথ পরিষ্কার করেন।

দেশে ফিরে ১৯৪১ সালে ফ্যাসিবাদী জার্মানীর আক্রমণ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে একদল যুবকের সাথে ভূপেশ গুপ্ত নিজেকে নিয়োজিত করলেন সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির কাজে। এই সময়কালে নেমে এসেছিল বাংলার বুকে মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তরের করাল ছায়া। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গঠিত হলো পিপলস রিলিফ কমিটি যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত। এইভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও দেশপ্রেম ভূপেশ গুপ্ত’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ালো।

সুদীর্ঘ ৪০ বছরের বহুমুখী রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৮১ সালের ৬ আগস্ট। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্যপদ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে। ১৯৫১ সাল থেকে যুক্ত পার্টির রাজ্য কমিটির মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি থেকে ১৯৫৪-৫৭ সালে কেন্দ্রীয় পার্টির মুখপত্র ‘নিউ এজ’ এবং ১৯৬৪ সালে পার্টি বিভাজনের পর ১৯৬৬ সাল থেকে মূল পাটিরই ঐ মুখপত্রের আমৃত্যু সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে রাজ্যসভার সদস্য হন এবং উপর্যুপরি ৫ বার তিনি সেই পদে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আসীন ছিলেন। বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রয়োগ করে সংসদকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কাজে ব্যবহার করার অন্যতম পথিকৃৎ ও প্রতিষ্ঠান ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত।

ভারতের সমস্ত রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের সমস্যাকে ভূপেশ গুপ্ত চাপাবাজি, ধাপ্পাবাজির দক্ষতা, নিপুণতা এবং অসাধারণ শৈলীর মাধ্যমে রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং সংসদ— এই তিন ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ভারতের সুবিধাবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এইভাবে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে ভারতের ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।

সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে পার্টির কাজে লাগানো, শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থকে দলিত করা, নারীদের অধিকারের নামে ধাপ্পা দেয়া, দেশের সংহতিকে টিকিয়ে রাখা, জাতিসমূহকে পরাধীন করে রাখা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অটুট রাখা, ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে রাখতে কাজ করা এবং তার প্রভাবকে স্থায়ীরূপ দেয়ার জন্য, সামন্তবাদের অবশিষ্টাংশের উচ্ছেদকল্পে, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রাধান্য সৃষ্টিতে, টাটা-বিড়লাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনি জীবন পাত করেন।

১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা জারির পর সারা দেশে যখন ইন্দিরা গান্ধীর ফাঁসির দাবি উঠছিল, তখন ইন্দিরার বিরুদ্ধে সামান্য ক্ষোভ দেখিয়ে ইন্দিরাকে রক্ষা করতে তার কৌশল ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন স্বৈরতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী এবং গণতন্ত্রহত্যাকারীদের পক্ষের এক চিরন্তন বন্ধু। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং সিপিআইয়ের সুবিধাবাদের অক্লান্ত যোদ্ধা।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তার সুবিধাবাদী যোগাযোগ ছিল। ১৯৬০ ও ১৯৬৯ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে তিনি ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষের সঙ্গে তিনি পার্টির প্রতিনিধি হয়ে চীনে যান এবং মাও সে তুং এর সঙ্গে আলোচনাও করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বশান্তি সম্মেলনে, বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন, কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সম্মেলন, বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধী সম্মেলন প্রভৃতির প্রতিনিধি হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

রাজনীতির ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও ভাষ্য রচনা, সাংবাদিকতায় ক্ষুরধার লেখনীর বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশনা এবং সংসদ কক্ষে বিষয়বস্তুর তথ্যনিষ্ঠ ও সত্যনিষ্ঠ উন্মোচন— এই তিনটি দিক ভূপেশ গুপ্তকে চালাক ও ধুরন্ধর করে তুলেছিল।

১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের পর্বে পার্টির ঐক্য অটুট রাখার ক্ষেত্রে তার ছিল সুস্থিত ঐকান্তিক প্রয়াস। এ কেবল সাংগঠনিক ভাবেই নয়, উভয় অংশের খসড়া কর্মসূচির পার্থক্যের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করার ক্ষেত্রে ছিল প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবুও তিনি পার্টির দুর্ভাগ্যজনক বিভাজনকে ঠেকাতে পারেননি। কারণ বিপ্লবীরা এইসব সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদীদের বর্জন করেছিল।

বাংলাদেশ ও ভারতের কমিউনিস্ট রাজনীতিকে এগিয়ে যেতে হলে ভূপেশ গুপ্তের মতো সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেই এগিয়ে যেতে হবে।

তথ্যসূত্র

১. ভূপেশ গুপ্ত, জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি, সম্পাদনা ভানুদেব দত্ত, ভূপেশ গুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০১৪, পৃষ্ঠা ৭-৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!