বাদল মজুমদার একজন লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা

বাদল মজুমদার একজন লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা । তিনি ২৪ মার্চ ১৯৪৯ তারিখে নেত্রকোণা সদরের বড়পুকুর পাড় গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ক্ষিতিশ চন্দ্র মজুমদার, মাতার নাম দেবী প্রভা মজুমদার। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় নেত্রকোণা জেলাধীন নিউটাউন বড়পুকুরপাড়স্থ বীনাপানি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি হতে দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে, ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করে স্কুল জীবন শেষ করেন। ১৯৬৯ সালে এইচএসসি নেত্রকোণা সরকারি কলেজে বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন এবং ১৯৭২ সালে বিকম পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ আইন কলেজে ভর্তি এবং ১ বৎসর পড়াশুনা করে ইতি টানেন।

দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুবাদে মেছুয়া বাজার রোডে মাসির বাসায় চলে আসেন। মাসির বাসায় চলে আসার কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করেন। তার সবচেয়ে কারণ হলো সহপাঠীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো মোক্তারপাড়া এলাকার। প্রথমেই তিনি শিশু সংগঠন কচি কাচাঁর আসরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। আর তখন যাঁরা কচি কাচাঁর আসর করতো পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের সদস্য ও সোনার বাংলা খেলাঘর আসর যারা করতো তারা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হতো।

বিভিন্ন সংগঠনের লোকজনের সাথে মেলামেশার কারণে স্কুলে পড়ার সময় তিনি স্কুল ছাত্রলীগ শাখার সদস্য হন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনে মিছিল, সভা, সমাবেশে অংশ নেন। এখানে উল্লেখ্য তখনকার মিছিলে স্কুল সংগঠনের কর্মীদের সামনের সারিতে রাখা হতো যাতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও নেতাদের গ্রেফতার না করতে পারে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৩ সাল হতে নেত্রকোণা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমাদের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে মেহের ভাই, জোহা ভাই, জামাল ভাই, মতি ভাই তাদের পরিচালনায় বিভিন্ন আন্দোলনে। সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। আর তারই প্রতিশ্রæতিতে তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রথমে জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক, সাংগাঠনিক সম্পাদক, সহ-সভাপতি, সম্মানিত সদস্য হিসাবে এবং কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্যানেল মনোয়নের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।

যাই হোক, ১৯৬৬ সাল হতে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জীবনের বহু চড়াই, উৎরাই হয়েছে এবং মানব জন্মে জন্ম নেয়ার স্বার্থকতা উপলব্ধি করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া উনার মানব জন্মের গর্ব, অহংকার মনে করেন। এর পরে উনার আর চাওয়াা পাওয়ার কিছু নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেত্রকোণা ইতিহাস (১৯৬২) সাল হতে ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারী) শেখ মুজিবের কাছে অস্ত্র জমা দেবার সময় পর্যন্ত অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে যারাই গবেষণা করবেন আমার নামটা উনার সকলের সাথে থাকবে। এর চেয়ে বড় পাওনা তাঁর আর কি বা থাকতে পারে?  প্রতিকূল অবস্থার মাঝে ১৯৭০ নির্বাচনে নেত্রকোণা শহরে রাতের পর রাত আলকাতরা নিয়ে দেয়ালে নৌকায় ভোট দিন, তোমরা রক্ত দাও, আমি স্বাধীনতা দেব এসব শ্লোগান লিখা ও আওয়ামী লীগ অফিসে পোস্টার লিখা আজও তাঁকে অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মোক্তারপাড়া মাঠে ২৬ মার্চ জয়বাংলা বাহিনীর কুঁচ-কাওয়াজ, ফার্মের ম্যানেজারের অস্ত্র লুঠ, মালখানা লুট, নাগড়া রেষ্ট হাউসে তৈল, গ্যাস কোম্পানীর ডিনামাইট লুঠ, সরকারী গার্লস স্কুলে জয়বাংলা বাহিনীর কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব পালন ছাড়াও পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের ভারতে ট্রেনিং এর জন্যে রিক্রুটসহ, ডেরাডুন, ট্রেনিং নেয়া এবং মহিষখলা, রংরা, খেরাপাড়া নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি থানা বোয়ালী গ্রামে আব্দুল মান্নানদের বাড়ীতে ক্যাম্প পরিচালনা, মোহনগঞ্জ গণ-আদালতের আসামীদের নেত্রকোণা হতে ধরে মোহনগঞ্জ প্রেরণ এ গুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার স্মৃতি বার বার ভেসে উঠে। বর্তমান নেত্রকোণা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যা ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভোরে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব ফজলুর রহমান খান কর্তৃক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিলো তার স্থান নির্ধারণ কমিটির সদস্য পরিকল্পনাসহ সামগ্রীক কার্যক্রম ও ১৯৬৪ সালে পুরাতন শহীদ মিনারের (স্বাধীনতাবিরোধী দ্বারা ধ্বংশপ্রাপ্ত) নির্মাতা রথিন ঘোষ, কাঞ্চন বিশ্বাস এর সাথে জড়িত থাকতে পেরে আজও গর্ববোধ করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে যারা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন নেত্রকোণার সবাই জাসদের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে যান। তারই ফলশ্রুতিতে নেত্রকোণা জেলা জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের ৫ জনের মধ্যে ১ জন তিনি। ১৯৭৩ সালে জাসদের রাজনীতির সূত্রধরে রিক্সা শ্রমিক লীগের সম্পাদক, নেত্রকোণা জেলা সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক, জেলা কৃষকলীগের সম্পাদকের দায়িত্ব দীর্ঘদিন পালন করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা ও ভারতীয় হাই কমিশনসহ বিভিন্ন থানা পুলিশ ক্যাম্প লুণ্ঠন রাজনৈতিক হত্যা ও গনবাহিনী কর্তৃক গুম, খুন, লুটসহ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের প্রতিবাদে তিনি জাসদ হতে পদত্যাগ করেন এবং ঔষধের ব্যবসায় চলে যান।

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে হত্যার পর তাঁকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে তৎকালীন এসডিপি মিষ্টার মাইন উদ্দিন চিশতি সাহেব তাঁকে ১ বৎসর (সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা) উনার অফিসে প্রতিদিন হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে আবার কর্নেল তাহের সাহেব গ্রেফতার হবার পর এবং উনার বিচার চলাকালীন পুনরায় হয়রানি করা হয়। যাই হোক এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে বর্বর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করার দিন তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে নেত্রকোণা বিডিআর ক্যাম্প ও পরে ময়মনসিংহ ডিজিএফআই অফিসে এবং রাত ৯টায় ময়মনসিংহ জেলে পাঠানো হয়। ৪ মাস পর মুক্তি পেয়ে তাঁর শহরে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে গ্রামের বাড়ীতে চলে যান।

আরো পড়ুন

ইতিপুর্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে জড়িত হয়ে বড় বাজারের জেলা কার্য্যালয়ে সংসদ কর্তৃক এ মাটি, রক্ত, রাঙ্গা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হয়ে এর প্রকাশনার সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ২০১০ সাল হতে আমার নেত্রকোণা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির প্রথম সহ-সভাপতি সম্পাদক ও বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বাংলা কৃষ্ণ গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে সভাপতির দায়িত্ব পালন করার তাঁর সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে ৮ জন শিক্ষক নিয়োগ ও বিদ্যালয়ের অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য তিনি গর্ববোধ  করেন।

তথ্যসূত্র

১. বাদল মজুমদার রচিত এবং অনুপ সাদি সম্পাদিত গ্রন্থ ‘নেত্রকোনার ইতিহাসে কয়েকটি প্রসঙ্গ‘ গ্রন্থের লেখক পরিচিতি অংশ থেকে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!