অগাস্ট কোঁত বা ওগুস্ত কোঁত বা অগাস্ট কোঁৎ বা ওগ্যুস্ত কঁৎ বা অগাস্ট কোঁতে (ইংরেজি: Auguste Comte, ১৯ জানুয়ারি, ১৭৯৮ – ৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭) ছিলেন দৃষ্টবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী সমাজতত্ত্বের প্রবর্তক একজন ফরাসি দার্শনিক। আধুনিক অর্থে তাকে প্রায়শই বিজ্ঞানের প্রথম দার্শনিক হিসাবে গণ্য করা হয়। সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের জন্যও কোঁতের ধারণাগুলি মৌলিক ছিল; প্রকৃতপক্ষে, তিনি শব্দটি উদ্ভাবন করেছিলেন এবং সেই বিষয়টিকে বিজ্ঞানের মুকুট হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।[১]
অগাস্ট কোঁতে ১৭৯৮ সালের ১৯ জানুয়ারি হেরাল্টের মঁৎপেলিয়েতে জন্মগ্রহণ করেন। লিসি জোফ্রি এবং তারপর মঁৎপেলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর, ফরাসি বিপ্লবের উত্তরকালে তিনি পারির প্রগতিশীল ইকল পলিটেকনিকে যোগ দেন। ইকল পলিটেকনিক প্রজাতন্ত্রবাদ এবং প্রগতিবাদ নামক ফরাসি মতবাদের প্রতি আনুগত্যের জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল।
রাষ্ট্রদার্শনিক স্যাঁ সিমোর সচিব হিসেবে তাঁর কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী চিন্তার বিকাশে কোঁৎ সহায়তা করেন। পরে মতপার্থক্যের দরুন দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অতঃপর গণিতের শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ এবং ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে কোঁৎ দৃষ্টবাদী সমিতি গঠন করেন। বিপ্লবের পর ফ্রান্সে দুরূহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তিনি দৃষ্টবাদী রাষ্ট্রদর্শনের যে বিস্তার ঘটিয়েছেন সেটা মূলত স্যাঁ-সিমো’র ভাবভূমিতেই রচিত হয়।[২]
সাধারণভাবে ফরাসি বিপ্লবের গুণগ্রাহী হলেও অগাস্ট কোঁত সাম্য, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি ধরনের তত্ত্বকে বিপ্লবের কারণ হিসেবে নিন্দা করেন। তিনি চাইতেন একাধারে প্রগতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা। বস্তুত তিনি ছিলেন একজন মধ্যপন্থী। বিপ্লব ও রক্ষণশীলতার দ্বৈতধারার মাঝে পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি দৃষ্টবাদে পোঁছন। উদ্দেশ্য ছিলো সমাজের বিজ্ঞানসম্মত একটি রাজনৈতিক মতবাদ দাঁড় করানো।
অগাস্ট কোঁত মানবমন ও সমাজের তিনটি স্তর বা পর্যায়ে যে বিবর্তনধারা দেখিয়েছিলেন সেগুলি হলো দেবতত্ত্ব অর্থাৎ কাল্পনিক, অধিবিদ্যা অর্থাৎ বিমূর্ত, এবং দৃষ্টবাদ। অগাস্ট কোঁতে জ্ঞানের বিকাশে তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে জ্ঞানের বিকাশের আদিযুগ হচ্ছে ধর্মীয় যুগ। এই যুগে রহস্যের ব্যাখ্যায় মানুষ অতি-প্রাকৃতিক শক্তি বা ঈশ্বরের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জ্ঞানের ইতিহাসে দ্বিতীয় যুগ হচ্ছে দার্শনিক যুগ। এ যুগে দার্শনিক চরম কারণ বা চরম সত্তার অস্তিত্বের ভিত্তিতে মানুষ ও জগতের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এটাকে কোঁতে ধর্মীয় যুগেরই প্রকারভেদ বলেছেন। জ্ঞানের তৃতীয় বা শেষ যুগ হচ্ছে পজিটিভিজম বা দৃষ্ট প্রকৃতির যুগ। এ যুগে বিজ্ঞানের মাধ্যামে দৃষ্ট প্রকৃতিকে মানুষ চরম বলে স্বীকার করেছে। এ যুগে এসে মানুষ উপলব্ধি করেছে যে, প্রকৃতির বাইরে ঈশ্বর বা চরম সত্তার অনুসন্ধান নিরর্থক।[৩]
দৃষ্টবাদ শব্দটি তিনি বিজ্ঞানের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেন। নিয়মনিয়ন্ত্রিত চরাচরের একমাত্র দৃষ্টবাদী প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। উল্লিখিত দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় পর্যায়ে উন্নীত মানুষকে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে বিশ্লেষণ করা যায়। দৃষ্টবাদী পর্যায়ে মানুষ ঈশ্বর ও অন্যান্য ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পায়। অবশ্য নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একটি জীবনদর্শনের প্রয়োজন ঘটে।[২] তাঁর মতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা দৃষ্ট প্রকৃতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। দৃষ্ট প্রকৃতিই হচ্ছে চরমসত্তা। কাজেই বিজ্ঞান বা জ্ঞান প্রক্রিয়ার কর্তব্য হচ্ছে বাস্তব জগতের দৃষ্ট বিষয়ের বর্ণনা দান; অভিজ্ঞতার গভীরে অপর কোনো সত্তার অনুসন্ধান করা নয়।[৩]
সাধারণ নৈতিকতামণ্ডিত ভাবনাচিন্তা ও আচরণের তিনি একটি নিরীশ্বরবাদী উৎসের সন্ধানী ছিলেন। তার জন্য চেয়েছিলেন যাবতীয় সামাজিক সম্পর্কের ন্যায়সঙ্গত রূপায়ণ ও সর্বগ্রাহ্য কিছু মূল্যবোধের সমন্বয়। মূল্যবোধ স্থাপনের তাগিদে তিনি শেষাবধি দৃষ্টবাদী এক চার্চ-সংগঠন গড়ে তোলেন। কিন্তু দৃষ্টবাদী প্রত্যয় অভিজ্ঞতাসম্পৃক্ত ইহজগতের মধ্যে সীমিত; জ্ঞানাতীত অলৌকিকতা অথবা বস্তুর অন্তরালে নিগুঢ় সত্তা কিংবা অজ্ঞেয়বাদে আস্থাশীল নয়। বিজ্ঞানই জ্ঞানের উৎস।
অগাস্ট কোঁৎ-এর রাষ্ট্রচিন্তাতেও তিনি কাজের মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিদ্ধান্তের সমন্বয়ে বৈজ্ঞানিক বিধিবিধান গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু শেষাবধি তিনি এক প্রকার মানবপূজার পত্তন করেন। তার মধ্যে অবশ্য তিনি কোনও ধর্মবিশ্বাস সঞ্চার করেননি। অগাস্ট কোঁৎ-এর ইহলৌকিক উগ্র ভাবনাচিন্তা উত্তরকালে হিতবাদী মতাদর্শ থেকে শুরু করে মার্কসবাদী সমাজতত্ত্বকেও বিক্ষিপ্তভাবে প্রভাবিত করে।[২]
জ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস রচনার যে বিরাট চেষ্টা কোঁতে করেছেন সে চেষ্টায় তাঁকে আধুনিক ইতিহাসকারদের পথিকৃৎ বলা চলে। ধর্ম কিংবা দার্শনিক চরমসত্তার স্থানে প্রকৃতির প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টায়ও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয়। কিন্তু মানুষের স্থান কেবল তার দৃষ্ট বস্তুপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে – দৃষ্টের ভিত্তিতে অ-দৃষ্ট কোনো কিছু সম্পর্কে অনুমানের ক্ষমতা মানুষের নাই, এ মত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত সীমান্তের আর এক চরম মত। এর ফলে অগাষ্ট কোঁতের পজিটিভিজম বা দৃষ্টবাদকে চরম অভিজ্ঞতাবাদ বা ভাববাদের একটি প্রকারবিশেষ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক কোনো দর্শন বলে গ্রহণ করা চলে না।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, “অগাস্ট কোঁত দৃষ্টবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী সমাজতত্ত্বের প্রবর্তক” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/auguste-comte/
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১১৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।