অতুলপ্রসাদ সেন ছিলেন একজন দুর্দান্ত বাঙালি সুরকার, গীতিকার এবং গায়ক

অতুলপ্রসাদ সেন (ইংরেজি: Atul Prasad Sen; ২০ অক্টোবর ১৮৭১ – ২৬ আগস্ট ১৯৩৪) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন দুর্দান্ত বাঙালি সুরকার, গীতিকার এবং গায়ক। তিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিদও ছিলেন।

জন্ম ও পরিবার:

অতুলপ্রসাদ সেনের জন্ম ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর [ মতান্তরে ১৮৭২ ] ঢাকায়। তাঁর আদিবাড়ি ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর পরগনার অন্তর্গত মগর গ্রামে। তার পিতা রামপ্রসাদ সেন এবং মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন সুগায়ক ও ভক্তিগীতি রচয়িতা।

অতুলপ্রসাদের অনেক অল্পবয়সে বাবা মারা যায়। বাল্য কালে পিতৃহীন হয়ে অতুল প্রসাদ ভগবদ্ভক্ত, সুকন্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতিরচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। পরবর্তীকালে মাতামহের এসব গুণ তার মাঝেও সঞ্চালিত হয়। মাতামহের নিকটই সঙ্গীত ও ভক্তিমূলক গানে তার হাতেখড়ি। তিনি নিজেও ছিলেন সুকণ্ঠ গায়ক। তার সকল গুণই দৌহিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল এবং পরে সার্থকতা লাভ করেছিল।[১]

শিক্ষাজীবন:

বাল্যে পিতৃহীন অতুলপ্রসাদ মাতামহগৃহে প্রতিপালিত হন এবং সেখানে গানের পরিবেশ পান। বিদ্যালয়ে পঠন পর্বেই তিনি গায়করূপে বিখ্যাত হন এবং গান রচনা শুরু করেন।

অতুলপ্রসাদ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কিছুকাল কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিলেত থেকে ফিরে এসে প্রথমে কিছুকাল কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন।[২]

কর্মজীবন:

১৮৯৪ সালে কলকাতার পাশাপাশি রংপুরেও অনুশীলন শুরু করেন। যৌবনে লক্ষ্ণেীবাসী হন এবং সেখানেই আইন ব্যবসায় আরম্ভ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কালক্রমে তিনি আইন ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন ও লক্ষ্ণৌ-এর শ্রেষ্ঠ ব্যবহারজীবী রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আউদবার অ্যাসোসিয়েশন ও আউদবার কাউন্সিলের সভাপতি হয়েছিলেন।

পেশাগত সাফল্য লাভের সুযোগে অতুলপ্রসাদ লাক্ষ্ণৌ নগরের সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন এবং নানাভাবে সমাজের উপকার সাধন করেন। তার গৃহই হয়ে উঠেছিল নগরীর সারস্বত মন্ডলীর মিলনকেন্দ্র।

উপার্জনের বেশিরভাগ অর্থই তিনি ব্যয় করতেন স্থানীয় জনসাধারণের সেবার কাজে। পরবর্তী কালে নিজের বইয়ের স্বত ও বাসভবনটি সমাজসেবী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দান করেন। জীবিতকালেই তিনি এরূপ খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে নগরবাসী তার গুণ ও প্রতিভার সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়েছিল তার নামে তার বাসস্থানের রাস্তাটির নাম করন করে। জীবিতকালে এরূপ সম্মান লাভ বিরল ঘটনা।

এছাড়াও এই সময়ে কলকাতার সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘খামখেয়ালি সভা’য় তিনি জড়িয়ে পড়েন এবং সেখানে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যক্তিগত ও সাংগীতিক সান্নিধ্য পান। গান শোনেন সরলা দেবী চৌধুরানী ও রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর।

কলকাতা ও রংপুরে অল্পকাল আইন ব্যবসায় যুক্ত থেকে তিনি বরাবরের জন্য চলে যান লক্ষ্ণৌ শহরে। সেখানেই তার জীবন কাটে সফল আইনবিদ রূপে, গান গেয়ে ও রচনা করে, সমাজ ও দেশের নানা হিতকর কাজে। কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গেও তিনি এককালে যুক্ত হয়েছিলেন।[২]

অতুলপ্রসাদ সেন-এর গ্রন্থসংকলন:

অতুলপ্রসাদ সেনের রচিত বাংলা গানগুলিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় : স্বদেশি সংগীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান। ব্যক্তিগত জীবনের বেদনা সকল শ্রেণির সংগীতেই পরিস্ফুট। হিন্দুস্থানি সংগীতের সুর ও ঢং, বাউল ও কীর্তনের সুর ইত্যাদি যোগ করে তিনি বাংলা গানে এক বিশিষ্ট সংগীতরীতির প্রবর্তন করেন।

১. উঠ গো ভারতলক্ষ্মী
২. বল বল বল সবে শতবীণাবেণুরবে
৩. হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর
৪. তোমারি যতনে তোমারি উদ্যানে
৫. আমার হাত ধরে তুমি
৬. কে আবার বাজায় বাঁশি
৭. বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথা’ প্রভৃতি গানগুলি বিশেষ বিখ্যাত।

তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় ২০০। তাঁর গানের সংকলন ‘কয়েকটি গান’ ও ‘গীতিপঞ্জ’। ‘কাকলি’ গ্রন্থমালায় এ-সকলের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়। প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনের প্রতিষ্ঠাকালে তিনি তার অন্যতম প্রধান ছিলেন। সম্মিলনের মুখপত্র – ‘উত্তরা’র অন্যতম সম্পাদক এবং সম্মিলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে প্রথমে কংগ্রেসের অনুবর্তী ও পরে লিবারেল-পন্থী হন।[৩]

বাংলা সংগীত জগতের মহাপ্রতিভাধর এই গীতিকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৭৯-৮১।
২. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত (১ বৈশাখ ১৩৯৪)। আধুনিক বাংলা গান। কলকাতা প্যাপিরাস। পৃষ্ঠা: ১৬৫-১৬৬।
৩. প্রধান সম্পাদক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সম্পাদক অঞ্জলি বসু (দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০১৩)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খন্ড)। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ পৃষ্ঠা ১৩-১৪ আইএসবিএন 978-81-7955-135-6।

Leave a Comment

error: Content is protected !!