স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (ইংরেজি: Sir Arthur Ignatius Conan Doyle; ২২ মে ১৮৫৯ – ৭ জুলাই ১৯৩০) ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত চরিত্র রহস্যভেদী শার্লক হোমসের স্রষ্টা। তাঁর জন্ম স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। ডয়েল ছিলেন বহুমুখী গুণ ও নৈপুণ্যের মানুষ। তিনি হতে পারতেন অনেক কিছুই। কিন্তু সাহিত্য প্রীতি এবং শিল্প প্রবণতা তাঁকে আকস্মিকভাবেই নিয়ে আসে সাহিত্য ক্ষেত্রে।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারী পড়বার সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে ডঃ জোশেফ বেল-এর। সুদক্ষ শল্য চিকিৎসক এই মানুষটিব নির্ভুল ক্ষমতা ছিল রোগ নির্ণয়ের। কেবল তাই নয় সামান্য লক্ষণ থেকেই তিনি রোগীদের জীবন ও জীবিকার সন্ধান বলে দিতে পারতেন। ডয়েল ছিলেন ডাঃ বেল-এর প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম। তার ইচ্ছাতেই একসময় ডয়েল নিযুক্ত হয়েছিলেন তার আউট পেশেন্ট ক্লার্ক হিসেবে।
এই সুযোগটা ডয়েলের জীবনে শার্লক-প্রস্তুতি পর্বের সূচনা করল বলা চলে। কেননা, রোগীদের ইতিহাস টোকার মধ্যে দিয়েই তার মানুষের চরিত্র পর্যবেক্ষণের হাতে খড়ি হতে থাকল। তিনি যে নোট নিতেন, তার সঙ্গে ডাঃ বেল-এর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের হুবহু মিল দেখে তিনি অভিভূত হতেন। মানুষটির লজিক্যাল অ্যানালিসিস ডিডাকসন পদ্ধতির প্রতি এভাবেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ডায়াল।
ডয়েলের কাল্পনিক অপরাধ কাহিনীর নায়ক শার্লক হোমসের মধ্যেও আমরা দেখেছি এই গুণগুলিই আরও প্রখর ও বিকশিত রূপে। আঙুলের নখ, কোটের হাতা, বুট জুতো, প্যান্টের হাঁটু, তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের কড়া-পড়া চামড়া, মুখমণ্ডলের ভাব, শার্টের আস্তিন— এসব থেকে হোমস তার প্রাথমিক সমস্যাবলীকে আয়ত্তে আনতেন।
চিকিৎসা জগতটা এমন এক কঠিন ঠাই যেখানে এই জীবিকার মানুষদের প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য দীর্ঘ সময় এবং ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। ভাগ্যের জোরে কেউ কেউ অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই তা পেয়ে যায়। এরা সুনাম ও আর্থিক প্রাচুর্যের দাক্ষিণ্য লাভ করে। কিন্তু বাদ বাকি সকলকেই চেম্বারে বসে স্টেথো দিয়ে মাছি তাড়াতে হয়।
ডাঃ বেল-এর স্নেহভাজন হওয়া সত্ত্বেও ডয়েল জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা এড়াতে পারলেন না। লেখক হবার বাসনা না থাকলেও খেয়ালবশেই ইতিমধ্যে তিনি কয়েকটি গল্প লিখে ফেলেছিলেন এই সময়ে। কিন্তু তার প্রায় সবকটিই ফেরত এসেছিল সম্পাদকের দপ্তর থেকে। কেবল The story of Sasassa Valley গল্পটি ছাপা হয়েছিল চেম্বার্স জার্নালে।
এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে পাড়ি দিচ্ছিলেন ডয়েল। সেই সময়ে আকস্মিক ভাবেই চাকরি জীবনের হাতছানি এল। পঞ্চাশ পাউন্ডের বিনিময়ে সার্জন হিসেবে জাহাজে করে আর্কটিক যাতায়াতের দায়িত্ব পেলেন। বলাই বাহুল্য, এই সমুদ্রযাত্রা তার উত্তর জীবনে সাহিত্য রচনার রসদ হিসেবে কাজে লেগেছে।
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ফিরে এসে ডাক্তারী ডিগ্রি লাভ করে আবার রওনা হলেন আফ্রিকার পথে। কিন্তু তিন মাস পরেই ফিরে এলেন। এরপর তার স্থিতিহীন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল প্লাইমাউথ থেকে পাঠানো এক সহপাঠী বন্ধু ডাঃ বাড-এর টেলিগ্রাম।
বন্ধুটি তাকে প্লাইমাউথে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি নিজে সেখানে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল সাফল্য লাভ করেছেন। ডয়েল এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। তিনি বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে রওনা হয়ে পড়লেন।
ডয়েলের সহপাঠী ডঃ বাড ছিলেন টগবগে প্রাণবন্ত তরুণ। আধা প্রতিভাবান আধা হাতুড়ে এই মানুষটি ছিলেন কিছুটা খামখেয়ালি আর ঝোঁকগ্রস্তও। ফলে বন্ধুর সঙ্গে ডয়েলের পার্টনারশিপ বেশিদিন টিকল না। তিনি রীতিমত ঝুঁকি নিয়েই সাউথ সীর ১নং বুশ ভিলায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয়। ডয়েলের ঝকঝকে নেমপ্লেট হঠাৎ করে রোগীদের আকৃষ্ট করল না।
কিন্তু ভেঙ্গে পড়লেন না তিনি। অনমনীয় মনোবল নিয়ে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুঁঝবার শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। স্টেথো দিয়ে মাছি না তাড়িয়ে এবারে কলম নিয়ে বসলেন আর্থার কোনান ডয়েল। লন্ডন সিটি ম্যাগাজিনে গল্প লিখতে শুরু করলেন। দি কর্না হিল পত্রিকায় একটি গল্প প্রকাশিত হবার পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটতে লাগল। ইতিমধ্যে ডাক্তারিতেও কিছুটা রোজগার বেড়েছে। অল্প হলেও স্থায়ী রোজগারের পথ কিছুটা খুলেছে।
ভরসা করে ১৮৮১ সালের এপ্রিল মাসে বিয়ে করে ফেললেন মিস লুই হকিন্স নামের একটি তরুণীকে। বিয়ের কিছুদিন পরে একদিন কাগজ কলম নিয়ে বসে নানান আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে একটা গোয়েন্দা চরিত্রের নকসা ছকে ফেললেন ডয়েল। নাম ঠিকানাসহ স্বভাবটিও ধরে রাখলেন দু-চার কথায়। বলা যায় এই মানুষটিই ভ্রুণাকারে শার্লক হোমস।
অবশ্য প্রথমে নামকরণ হয়েছিল শেরিনফোর্ড হোমস, পরে বদল করে নাম রাখলেন শার্লক। গোয়েন্দার যে সহকারীটিকে নির্বাচন করলেন ডয়েল প্রাথমিকভাবে তার নাম ছিল অরমন্ড স্যাকার। এই নামটিও পছন্দ না হওয়ায় পরে বদলে করলেন ডাঃ জন এস ওয়াটসন।
ডয়েল ডাঃ বেল-এর ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন মরফিন আসক্ত শার্লক হোমসের কায়মূর্তিটি। অবশ্য এই চেহারার ছাঁচের মধ্যে মিশেছিল তার প্রপিতামহ জন ডয়েলের অয়েলপেন্টিং-এর স্মৃতিও।
ডাঃ ওয়াটসন মানুষটি কল্পনার সৃষ্ট হলেও তার আকৃতি-প্রকৃতি এবং নামের উৎস কিন্তু ছিল দুটি বাস্তব মানুষ। দুজনেই ছিলেন ডয়েলের বন্ধু। এদের একজন হলেন সাউথ সী-এর ডাঃ জেমস ওয়াটসন এবং অপরজন মেজর উড। এর চেহারাটিই প্রায় হুবহু পেয়ে গেছেন গল্পের ওয়াটসন।
মেজর উড-ও সাউথ সীতে থাকতেন এবং কিছুকাল ডয়েলের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন। এর পরেই শুরু হয় অদ্বিতীয় রহস্যভেদী গোয়েন্দা শার্লক হোমসের একের পর এক অ্যাডভেঞ্চার—রীতিমত ছকে বাধা গোয়েন্দা কাহিনী।
শার্লক হোমস পাঠকদের দরবারে প্রথম আবির্ভূত হলেন A Tangled Skein উপন্যাসে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য পছন্দ না হওয়ায় উপন্যাসটির নাম বদলে নতুন নামকরণ করলেন A study in skerlet.
শার্লক হোমসকে নিয়ে ডয়েল সবশুদ্ধ চারটি উপন্যাস এবং ছাপ্পান্নটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। প্রতিটি লেখার মধ্যে হোমস চরিত্রটি এমন নিপুণভাবে চিত্রিত করেছিলেন যে পাঠকরা বিশ্বাসই করতে চাইতেন না যে শার্লক হোমস কাল্পনিক মানুষ। ১৯৩০ সালে মৃত্যুর আগে ডয়েল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে পাঠকরা মনে করতেন শার্লক হোমস এক জীবন্ত ব্যক্তি আর সেই ব্যক্তি সকল রহস্যের সমাধান করতে পারেন। …
লেখকের জীবিতাবস্থাতেই হোমসের নামে পাঠকদের কাছ থেকে চিঠি আসত। একবার এক মহিলা হোমসকে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন। ডাকে আসা অধিকাংশ চিঠিতেই থাকে রহস্য সমাধানের নানা অনুরোধ। থাকে মুগ্ধতা জ্ঞাপন এবং সাক্ষাৎ প্রার্থনা।
বস্তুতঃ হোমস সত্যিকারের চরিত্র না হয়েও পৃথিবীর হোমস অনুরাগী মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন জীবন্ত অস্তিত্বের অধিক একটি ভাবমূর্তি। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ডয়েলের The Adventures of Sherlock Holmes প্রকাশিত হবার পর অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গল্পগুলি প্রথমে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত স্ট্রান্ড ম্যাগাজিনে।
ডয়েলের শার্লক হোমসের গল্পগুলো পৃথিবীর সব ভাষাতেই অনুবাদ হয়েছে। তৈরি হয়েছে দুশো ছায়াছবি ও টেলিফিল্ম। সারা পৃথিবীর পুলিশী তদন্তধারায় এনেছে পরিবর্তন। চীন মিশরে গোয়েন্দা পাঠক্রমে অবশ্যপাঠ্য এই গল্পগুলি। ডয়েলের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থায়।
প্রধানত গোয়ন্দা কাহিনীর লেখক হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হলেও ডয়েল বেশকিছু উপন্যাস ও অনেকগুলি নাটকও লেখেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো The Story of Waterloo, The Fires of Fate, The House of Temperley, The prison Belt ইত্যাদি।
প্রথম নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা স্যার হেনরি আরভিং। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ সেনানিবাসের স্বপক্ষে রচিত তার দুখানি বই হলো The great Boar War এবং The War in South Africa: Its causes and conduct. ডয়েলের Causes and Conduct of the World War গ্রন্থটি ইংরাজি ছাড়া আরও বারোটি ভাষায় প্রকাশিত হয়।
জীবনের অন্তিম পর্যায়ে ডয়েল অধ্যাত্মবাদী হয়ে পড়েন এবং এই সম্পর্কে বক্তৃতা দান ও রচনা লিখতে থাকেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্যার উপাধি লাভ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই তার মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১২৩-১২৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।