অর্চনা দত্ত জগতের আনন্দপথে বিপুল আগ্রহ নিয়ে দীর্ঘ ও ঋজু পায়ে হেঁটেছেন। এই হাঁটা কেবল নিজের জন্য ছিল না। আশপাশের সমাজ ও মানুষের দায় নিজের কাঁধে নিতে শিখেছিলেন তিনি। এই দায় বহন করতে গিয়ে কখনো ভয়ে পিছপা হননি। তিনি শান্তিপূর্ণ একটি সমাজ চান; এই চাওয়ায় তাঁর কোনো আত্মস্বার্থ নেই। নিজে বাঁচা এবং অন্যকে বাঁচতে দেয়ার মাঝেই তিনি সকলের চরিতার্থতাকে দেখেছেন।
কর্মস্থলে যে কজন অধ্যাপক আমাদের চোখে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি তাঁদের একজন। আমরা হয়ত শুনেছি, অমুক সন্ত্রাসীকে তিনি ভয় খাইয়ে দিয়েছেন, তমুক দুষ্ট লোককে এমন বকেছেন যে, সে আর ত্রিসীমানায় আসে না। আমরা আরো শুনেছি যে ড. অর্চনা দত্ত প্রচণ্ড ভীড় থাকায় ট্রেনে জানালা দিয়েই উঠে গেছেন। এমন অনেক কিংবদন্তি তাঁর সম্পর্কে বাতাসে ভেসে বেড়াত। নির্ভীক, সদালাপী ও স্বল্পভাষী এই মানুষটিকে প্রয়োজনে কঠোর হতে দেখেছি। সন্ত্রাসের জনপদে যারা কাজ করেছেন সেরকম জায়গায় অর্চনার মতো গুরুজন আমাদের খুব দরকার ছিল।
তিনি দেশ বিদেশে প্রচুর ঘুরেছেন। এই ঘোরার ভেতরে যেমন সমাজ ও মানুষের জীবন দেখার তাগিদ ছিল তেমনি ছিল নিজেকে দৃঢ়ভাবে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা। প্রশাসনিক পদে থেকেও নিজেকে জানা এবং অন্যকে জানানোর আকাঙ্ক্ষা তাঁর ভেতরে দেখেছি। কাজ করতে হলে কাজের ক্ষেত্র বাড়াতে হয়। আমাদের এই শিক্ষককে কখনোই ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে দেখিনি। বই পড়তে আগ্রহী ও পুস্তক প্রেমি এই মানুষটি সমাজে মূল্যায়িত উচ্চতর ডিগ্রিটি গ্রহণ করে নিজের কর্মও জানার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছিলেন তারুণ্যের শুরুর দিকেই।
কর্মস্থলে তাঁকে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উদার গণতান্ত্রিক নারী হিসেবে দেখেছি। তাঁর সম্পর্কে হয়ত কোনো ঘরোয়া আলোচনা উঠল, সকলেই তাঁর সদর্থক দিকগুলো নিয়েই কথা বললেন। আমরা শ্রদ্ধামিশ্রিত অনুভূতির সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতায় মুগ্ধ হয়েছি। আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত, কথাবার্তায় মার্জিত, চিন্তায় আধুনিক, কর্মে নিষ্ঠাবান, প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়, চেষ্টায় একাগ্র, পরিশ্রমে আস্থাশীল এবং মননে গতিশীল এই মানুষটিকে অস্থিরতায় ভুগতে দেখিনি। ক্ষুদে মালিকদের বাড়বাড়ন্ত আর অস্থিরতার এই যুগে স্থির ও প্রাজ্ঞ এই মানুষটি আমাদেরকে দীর্ঘদিন কাজে লেগে থেকে সফল হবার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
তাঁর বিশাল কর্মময় জীবনের গতি কর্মস্থল থেকে অবসর নেবার ফলে থেমে যাবে না, এটা আমরা জানি। জগতের আনন্দ-অনুষ্ঠানে যিনি দৈনন্দিন কর্মমুখরতায় অংশগ্রহণ করেন, তাঁর কাছে অবসর বলে কিছু নেই। আমাদের কালের গুরুজন হিসেবে আমরা তাঁকে অনুসরণ করি। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেকেই লিখবেন। অনেকেই আমার চেয়ে ভালো জানেন। আমি জানি যে তিনি আমাদের কাছে আমাদের কালের কর্মপ্রেরণায় উজ্জ্বল এক নায়িকা ছিলেন। তাঁর আলো আরো দীর্ঘকাল ছড়িয়ে থাকুক আমাদের মাঝে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।