অনুপ সাদি মার্কসবাদের একজন সবিশেষ কর্মি

  • হান্নান কল্লোল, কবি ও লেখক

অনুপ সাদি মার্কসবাদের একজন সবিশেষ একনিষ্ঠ কর্মি। সাম্যবাদী ধারার চিন্তক। অগ্রগামী প্রাবন্ধিক-গবেষক, সম্পাদক, কবি। নিবেদিতপ্রাণ উইকিপিডিয়ান, ব্লগার। দায়িত্বশীল শিক্ষক-প্রশিক্ষক। প্রাণ-প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশকর্মি।

অনুপ সাদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নানা দিক নিয়ে চারটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। তার সম্পাদিত একটি স্মারকগ্রন্থও আছে। তিনি মেহনতি জনতার মুক্তিকামী রাজনীতি বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন। রাজনীতিনির্ভর চারটি কবিতার বই রচনা করেছেন। পত্রপত্রিকার পাশাপাশি রোদ্দুরে এবং ফুলকিবাজ.কমে নিয়মিত লিখছেন। তার ব্যক্তিগত ব্লগ প্রাণকাকলিতে শিক্ষামূলক ও পরিবেশবিষয়ক হাজারখানেক নিবন্ধ লিখেছেন। বাংলা উইকিপিডিয়ায় চল্লিশ হাজারের অধিক সম্পাদনা করেছেন, দেড় হাজারের মতো প্রবন্ধ লিখেছেন, হাজার দেড়েক আলোকচিত্র সংযুক্ত করেছেন। ইউটিউবে তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তৃতা রয়েছে।

এই অনুপ সাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াকালে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট করেছেন। স্বদেশ চিন্তা সংঘের সাথে সক্রিয় আছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন। বিষয়ভিত্তিক পাঠচক্র ও মুক্ত আড্ডায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে আসছেন।

অনুপ সাদি কার্ল মার্কসের এই কথা মানেন যে, ‘মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে নিরূপণ করে না, বরং তার সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।’ সামাজিক চেতনাঋদ্ধ মানুষটি মননশীল ও সৃজনশীল যা কিছুই করেন, দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যথাসাধ্য অটুট রাখেন। মার্কসীয় তত্ত্বের নিরিখেই তিনি গঠনমূলক কার্যক্রমসহ সম্পাদনা ও নিজস্ব লেখালেখিতে অগ্রগামিতায় ভাস্বর হয়ে ওঠেন।

অনুপ সাদির কাব্যসৃষ্টি নিয়ে অল্প কিছু বলি। মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের মৌলিক ভিত্তিমতে তার কবিতায় বিবৃত-বিধৃত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সমাজজীবননিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অনুপ সাদি জানেন যে, সমাজের উপরিকাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ শিল্পসাহিত্যও মতাদর্শের অংশ হয়ে সভ্যতার অগ্রযাত্রায় শীর্ষস্থানীয় অনুষঙ্গরূপে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। তিনি যেহেতু সাহিত্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মেনেই লিখেন, তার কবিতায় আর্থসামাজিক রাজনীতিচেতনা, সমাজ-সংস্কৃতিসংবেদ, দেশকাল-প্রতিবেশভেদ, সংগ্রামশীলতা ইত্যাদির পাশাপাশি জগজ্জীবন বদলানোর কিছু বৈপ্লবিক সংকেত থাকাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত।

পরিশুদ্ধ মননের মর্মমূল থেকে উৎসারিত তার কবিতা ত্রুটিযুক্ত সমাজব্যবস্থা, অসংগতিপূর্ণ রাষ্ট্রপদ্ধতি, বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক অবস্থা, অস্থিতিশীল রাজনীতিক পরিস্থিতি, জনবিরোধী বিদ্যমান কালাকানুন ইত্যাকার বিষয়ে প্রতিবাদমুখরতায় সরব হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পরিপার্শ্ববোধের মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সাম্যবাদী রাজনৈতিক সচেতনতার যে স্ফুরণ তার কবিমানসে ঘটছে সেটাই তার চিন্তাকে ত্বরান্বিত করছে।

মৌল-মানবাধিকার বিঘ্নিত সমাজযাপন এবং স্বতঃসিদ্ধ রাষ্ট্রপীড়নে তার মধ্যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন প্রত্যাশার পাশাপাশি স্বতঃসক্রিয় দ্রোহিতাও জন্ম নিয়েছে। এমন একজন কবিতার গাঠনিক রীতি-বিধি কতটা মানলেন সেটা তেমন গুরুত্ববহ কিছু নয়। এখানে সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিনের একটি বাণী তুলে ধরছি, ‘দূর হোক অ-পার্টি সাহিত্যিক! দূর হোক অতি-মানব সাহিত্যিক! সাহিত্যের ব্যাপারটাকে হতে হবে সমগ্র প্রলেতারিয়েতের কর্মযোগের একটা অংশ।’ সেদিক থেকে অনুপ সাদি একজন ‘পার্টি-সাহিত্যিক’।

অনুপ সাদির প্রতিটি কবিতাতেই প্রতিবাদ–দ্রোহ, অসঙ্গতিচিত্র, আহ্বান-প্রত্যাহ্বান, পরিবর্তনসংকেত, প্রথাবিরুদ্ধতা, অপশক্তি ধ্বংসধ্বনি, প্রাণপ্রকৃতিপ্রীতি ইত্যাদির দু’য়েকটি হলেও মিলবে আশা রাখি। আমার বক্তব্যের সমপার্শ্বিকে নমুনাস্বরূপ কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করছি–

ক. ‘আমরা আসছি সমস্ত রাষ্ট্রীয় গোলামি খেদিয়ে
আমরা রক্ষা করব আমার শ্রমিক আর কৃষক,
বাঁচাব আমার সোঁদা মাটি গন্ধ,
তুমিই আমার ঝলসিত প্রেমের গন্তব্য,
আমরা পৌঁছাবই তোমার মুক্তির বন্দরে’

(কিছু রক্ত এখনো বিদ্রোহী: আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প)।

খ. ‘আমার রক্তে শুধু অগ্নিস্রোতের লাভা
আমাদের রক্তে শুধু লাভার অগ্নিস্রোত’

(পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি: পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি)

গ. ‘তারা একদা মানুষ ছিল আর এখন শ্রমিক
তারা ভাতের থালাকে মাথার বালিশ বানিয়ে ঘুমায়’

(গর্ততত্ত্ব ও সংগ্রাম: উন্মাদনামা)।

ঘ. ‘বুঝবে শুধু জীবনই সুন্দর,
জীবনের প্রতিটি ভাঁজে সুন্দরের আহ্বান’

(আবেগের ঝর্ণাধারায় একদিন: মনোজগতে মঙ্গা উপিরিকাঠামোতে লেহেঙ্গা)।

ঙ. ‘আমরা সঙ্গে নেবো শ্রমিকের শ্রমপূর্ণ অমর দুইটি কারুশিল্পময় হাত
তুমিও সঙ্গে এসো দেরি করবো না হাত ধরো হাত ধরো আমার সমতা’

(সমতা আর আমি, আমরা দুজনে: বৃষ্টির ফোঁটায় আসে আমাদের ঠোঁটে ঠোঁটে কবিতাবাগান)।

আগেই বলেছি অনুপ সাদি তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন। সেগুলোর একটি হলো মার্কসবাদ। বইটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার আগে মার্কসবাদ বিষয়ে একটু কথা বলতেই হয়। মার্কসবাদ শুধু দর্শন নয়, বিজ্ঞানও। যে কোনো দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতোই এটি চূড়ান্ত কিছু নয়। বরং বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও বিকাশযোগ্য। এই মতবাদের সমালোচনা হওয়াই স্বাভাবিক, দরকারি তো বটেই। মার্কসবাদ বলতে কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের একক মতবাদকে বোঝায় না। আসলে দ্বন্দ্ববাদ তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের স্বতঃসক্রিয় প্রবাহটাই মার্কসবাদ। সেই ক্রমাগ্রগতিসম্পন্ন গতিধারা প্রথম বিধিবদ্ধ করেন মার্কস-এঙ্গেলস। পাশ্চাত্য রীতি মেনে সবিশেষ চিন্তাধারাকে মার্কসের নামের সাথে ব্যক্তিক মতবাদ হিশেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। লেনিন-স্তালিন-মাওসহ পরবর্তী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীগণ মার্কসবাদকে বিকশিত করে চলছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ভাষায় মার্কসবাদের ওপর বই রচিত হচ্ছে।

বাংলা ভাষায় এম. এন. রায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার মুখোপাধ্যায়, সুজিত সেন, ডা. মনোজ দাশ, দেবু গোস্বামী, অনুনয় চট্টোপাধ্যায়, শোভনলাল দত্তগুপ্ত, হারুন রশিদ, বদরুদ্দীন উমর, হায়দার আকবর খান রনো, হুমায়ুন কবির, অনুপ সাদি প্রমুখ মার্কসীয় চিন্তকগণ মার্কসবাদের ওপর গ্রন্থ লিখেছেন।

সাবলীল ভাষাভঙ্গিতে ও বর্ণনা নৈপুণ্যে সহজবোধ্য বইগুলোর মধ্যে অনুপ সাদির মার্কসবাদ অন্যতম। বইটিতে মার্কসবাদের প্রাথমিক ধারণা দিতে কয়েকটি মূল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। মহান মতাদর্শটির ধারণা ও রূপরেখা, তিনটি উৎস ও তিনটি উপাদান, মূলনীতিসমূহ, পুঁজিবাদী অর্থশাস্ত্র, মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মার্কসীয় ধারণা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদ চর্চা নিয়ে আলোকপাত করেছেন অনুপ সাদি।

অনুপ সাদির আরেকটি প্রবন্ধগ্রন্থ সমাজতন্ত্র। বইটিতে সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক বিষয়ের সাথে প্রায়োগিক দিক নিয়ে অত্যাবশ্যকীয় আলোচনা রয়েছে। সমাজবদলের প্রাগ্রসর এই মতবাদের বিজ্ঞান ও দর্শন সরল সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, রূপরেখা, উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ কয়েকটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে উঠে এসেছে। পাশাপাশি পৃথিবীব্যাপি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও তার ইতিহাস সংক্ষেপে বিধৃত হয়েছে।

অনুপ সাদি রচিত আরও একটি গ্রন্থ নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ। বাংলা সাহিত্যের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী লেখকের প্রগাঢ় জীবনবোধ, অগ্রসর চিন্তাধারা, নির্ভীক প্রকাশভঙ্গি, ব্যতিক্রমী কর্মপদ্ধতি, চাঁছাছোলা আচার-ব্যবহার ও তির্যক অথচ মজাদার মন্তব্য এবং তার সম্পর্কে প্রচলিত গল্প, রম্যকথা ইত্যাদি উঠে এসেছে এই বইয়ে। অনুসন্ধিৎসু অনুপ সাদির বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধের সাথে হুমায়ুন আজাদের একটি সাক্ষাৎকার, গ্রন্থপঞ্জি ও জীবনপঞ্জি সন্নিবেশিত রয়েছে। সত্যনিষ্ঠ ও স্পষ্টভাষী হুমায়ুন আজাদকে আরেকটু জানতে বইটি কাজে আসবে সম্যকভাবে।

অনুপ সাদির সম্পাদিত গ্রন্থ, স্মারকগ্রন্থসহ ৫টি। অল্পকথায় সেগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। অনুপ সাদি তাহা ইয়াসিনের সাথে সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন নারী। সেখানে দুই বাংলায় রচিত নারী বিষয়ক চার শতকের নির্বাচিত প্রবন্ধের সাথে অনূদিত বিদেশি প্রবন্ধও স্থান পেয়েছে। নারীর জীবন-বাস্তবতা, সংকট-সংগ্রাম, অধীনতা-লাঞ্ছনা, বঞ্চনা-বৈষম্য, অবনয়ন-অবদমন, যৌনদাসত্ব, ভুৎভবিষ্যত ইত্যাকার বিষয় বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। সেই সাথে নারীস্বাধীনতা ও নারীপ্রগতি, বিভিন্ন আন্দোলনে নারীর ভূমিকা এবং পরিবার ও সমাজে নারীর ত্যাগ-তিতিক্ষার বস্তুনিষ্ঠ বয়ান রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে নারীর অবদান, সমাজ বদলে নারীর অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধানী ভাষ্যও সন্নিবেশিত আছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বহুবিধ পশ্চাৎপদতা থেকে নারীর উত্তরণঅন্বেষা খুঁজতে এবং নারী অধ্যয়ন অব্যাহত রাখতে নারী গ্রন্থটি খুবই সহায়ক।

অনুপ সাদি সম্পাদিত বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তদ্বিষয়ক দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ বই। এটি ধর্মনিরপেক্ষতার বহুবিধ দিক নিয়ে বাঙালি চিন্তকদের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সংকলন। বইটিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারণা-উদ্ভব-বিকাশ, সংজ্ঞা-বৈশিষ্ট্য-পন্থা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, উদ্দেশ্য-প্রয়োজনীয়তা এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাপদ্ধতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিন্তাচেতনার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা জানি সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি অগ্রসর মতবাদ। উন্নততর সামাজিক আদর্শ, গঠনমূলক পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডভিত্তিক বিজ্ঞানসম্মত রাজনৈতিক ধারাকে সক্রিয় ও বিকাশমান রাখতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিষয়ে আলোচনা অত্যাবশ্যক।

ভাববাদের বলয় থেকে মানুষকে মুক্ত করার মহৎ প্রচেষ্টায় জর্জ জ্যাকব হোলিয়াক, বেরি কসমিনসহ ইউরোপের কয়েকজন চিন্তক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে সূত্রায়িত করেন। ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের ক্রমাগত প্রগতিশীলতার ইতিহাসে ইহা রাষ্ট্রীয় আদর্শিক নীতিরূপে ঘোষিত হয়। ক্রমবিস্তারশীল ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শটি বাঙালির চিন্তন ও মননে জায়গা করে নেয়। জনগণের সাথে রাষ্ট্রের ধর্ম সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক মতবাদটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানব পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে বাঙালির গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতিসত্তায় প্রভাব ফেলতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা জায়গা পায়। চিন্তাশীল বাঙালি লেখকদের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি পরের বছর বাংলা একাডেমি গ্রন্থিতও করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সমাজ জীবনে প্রয়োগহীনতায় ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা মুখ থুবড়ে পড়ে সেটা আমরা বুঝতে পারি যখন স্বৈর শাসনামলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়ে যায়। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অতীত ও বর্তমান অবস্থা হতাশাজনক হলেও ক্রমাগত চিন্তাচর্চায় এবং প্রাত্যহিকতায় প্রয়োগের মাধ্যমে এর উত্তরণ ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। কেননা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদও বিকাশশীল আদর্শ যা চিন্তাভাবনা, আলোচনা-পর্যালোচনা, তর্কবিতর্ক, অনুশীলন ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া যাবে। বাংলাদেশের উদগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ ও অন্ধত্ব-জঙ্গিত্বে জর্জরিত গভীর তমসাবৃত পরিস্থিতিতে বাঙালির উন্নততর জীবনবোধ, সম্প্রীতি সামাজিক পরিবেশ, জনমনে নীতি নৈতিকতা বিনির্মাণে অনুপ সাদি সম্পাদিত বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যথেষ্ট কাজে আসবে আশা করি।

অনুপ সাদির সম্পাদনায় বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বইটি তদসংশ্লিষ্ট অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সংকলন। গ্রন্থটিতে সম্পাদকের একটিসহ প্রথিতযশা চিন্তকদের ৩২টি প্রবন্ধ আছে। সেগুলোতে গণতন্ত্রের স্বরূপ, উদ্ভব, উত্তরণ, যাত্রাভিষেক, গণচেতনা, সংগ্রাম, সমস্যা, সংকট, প্রতিবন্ধকতা, শত্রুমিত্র, বুর্জোয়াপনা, ভুৎভবিষ্যত; গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীনতা, নেতৃত্ব, অভিযাত্রা, সাম্যাকাঙ্খা, মুক্তিকামিতা, ঐতিহ্যবোধ, বৈপ্লবিকতা, দায়বদ্ধতা এবং গণতন্ত্রের সাথে সংস্কৃতি, সাম্যবাদ, সমাজবিবর্তন, দায়িত্বশীলতা, মানবাধিকার, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, শ্রেণিচেতনার সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে। বইয়ের লেখা নির্বাচনে লেখকদের মেধা ও প্রজ্ঞার পাশাপাশি মননশীলতা সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

অনুপ সাদির কয়েকটি বক্তৃতা দেখুন

আমরা জানি যে মানবিক আদর্শগুলোর মধ্যে নীতি-নায্যতার বিচারে পুঁজিবাদের প্রচ্ছন্ন দর্শনতত্ত্ব গণতন্ত্রের স্থান সর্বকল্যাণকামী সমাজতন্ত্রের পরে হলেও সাম্প্রতিক পৃথিবীতে গণতন্ত্রই অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে গেছে। বাঙালি রাজনৈতিক জীবনেও আদর্শ হিশেবে গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য আকাঙ্খা, প্রচেষ্টা, কর্মসূচি, লড়াই-সংগ্রাম বাঙালির মনে গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ মোটামুটি ঘটিয়েছে। বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় জনগণই প্রাধান্য পেয়ে আসছে, যদিও বাস্তবে তার প্রতিফলন কমই মিলেছে। গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার বিকাশে বুর্জোয়া শাসক সমাজের ভূমিকা নেই বললেই চলে। গণতন্ত্রকে তারা ক্ষমতায় গিয়ে শোষণ চালানোর হাতিয়ারই ভেবেছে। প্রায় সব বাঙালি জনতাও ভোটাধিকার প্রয়োগ ও মুক্তিকামিতাকেই গণতন্ত্রের অন্বিষ্ট ধরে নিয়েছে। তারা প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশীদার হয়েও সুফল ভোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ শিক্ষা নিয়ে গণতন্ত্রের সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা স্মরণে রেখে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশেও গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে। তদুদ্দেশ্যে গণতন্ত্রের প্রার্থিত অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার তাত্তি¡ক নির্দেশনা পেতে পড়তে হবে বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বইটিকে।

অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের সাহিত্য বিষয়ক সতেরোটি প্রবন্ধ সংবলিত একটি আকর গ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে–যাতে সম্পাদকের সুচারু পূর্বকথা, নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা ও পর্যাপ্ত টিকা সংযোজিত আছে। সাহিত্যের মৌলিক ভিত্তিগুলি বুঝতে এবং সাহিত্য সৃষ্টির যথাপ্রক্রিয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও অনুশীলনপ্রণালী উপলব্ধি করতে সাহিত্য সম্বন্ধে লেনিনের চিন্তাধারা ও মূল্যায়ন খুবই দরকারি। ভিন্ন ভাষায় রচিত অগ্রসর সাহিত্যের সমপার্শ্বিকে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান জানতে, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশিত গতিপ্রকৃতি বুঝতে এবং সাহিত্যে প্রাগ্রসর ও পশ্চাদপদ উপাদানসমূহ চিহ্নিত করতে বিপ্লবী মতাদর্শ মার্কসবাদের যোগ্যতম উত্তরসূরি লেনিনের সাহিত্য প্রসঙ্গে বইটি অধ্যয়ন জরুরি।

অনুপ সাদির সর্বশেষ সম্পাদিত গ্রন্থ হচ্ছে শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ। দোলন প্রভাকে সাথে নিয়ে তিনি সেটি সম্পাদনা করেন, যা সাবের শাহেরা স্মারক ট্রাস্ট ঠাকুরগাঁও থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে লোকসংগীত শিল্পী, কারুশিল্পী, সাঁতারু, প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশকর্মি, শিক্ষানুরাগী, সমাজ সেবক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহেরা খাতুনের (২২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ – ০২ জুন ২০২১) জীবনপঞ্জি, কথোপকথন, আলোকচিত্র এবং শাহেরা খাতুনকে নিয়ে মূল্যায়ন, স্মৃতিচারণ, নিবন্ধ ও কবিতাগুচ্ছ স্থান পেয়েছে।

করিৎকর্মা অনুপ সাদি টাঙ্গন থেকে প্রকাশিত কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার বইয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে চমৎকার একটি ভূমিকাও লিখে দিয়েছেন।

লেখার কলেবর ছোটো রাখতে এই পর্যন্ত এসে উপসংহার টানলেও চলতো। কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় অনুপ সাদিকে নিয়ে আরেকটু তথ্য সংযোজন করতে চাচ্ছি। অনুপ সাদির পড়াশোনা, জানাবোঝা, লেখালেখি নিয়ে যাদের দ্বান্দ্বিক আগ্রহ বা কৌতূহল রয়েছে তাদের জন্য সামাজিক মাধ্যম থেকে সংগৃহীত তার কিছু কথা উদ্ধৃত করছি।

  1. ‘বাম-বুর্জোয়া, ব্যক্তি-স্বাধীনতাবাদী বুর্জোয়া, বৈচিত্র্যপন্থী ক্ষুদে-বুর্জোয়াদেরও কমিউনিস্ট সাজতে মনে চায়। এসব বাম-বুর্জোয়া ও বুর্জোয়াদের পদলেহকেরা দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষতান্ত্রিক, দেহপ্রদর্শনপন্থী যৌনাভিনয়কারী পুঁজিবাদী শিল্পীদের পক্ষে অবলীলায় দাঁড়িয়ে যায়।’…
  2. ‘বিজ্ঞান বুর্জোয়া ব্যাপার এবং প্রতিক্রিয়াশীল। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো সকল শ্রেণিই কাজে লাগাতে পারে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অতি ক্ষুদ্র অংশ বিজ্ঞান। বিজ্ঞান অংশ, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সমগ্র। বিজ্ঞানবাদীরা শোষণ এবং শ্রেণি নিয়ে কথা বলে না। বিজ্ঞান বুর্জোয়াদের সেবা করে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সেবা করে শ্রমিক কৃষকদের। বিজ্ঞান শোষণের হাতিয়ার থেকে যাবে, যদি তাকে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অধীন করা না যায়।’…
  3. ‘আমি ১৫ বছর ধরে বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০% শিক্ষককে ছাঁটাই করতে হবে। কারণ তারা কিছু জানে না। মূর্খদের ক্লাস কেউই করতে পারবে না। যোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চেয়ে শিক্ষকদের ২৫ গুণ বেশি বেতন দিতে হবে।’’…
  4. ৪.         ‘পুঁজিবাদ একটি মোবাইল অ্যাাপ বানাক পাবলিককে ঠাণ্ডা করার; অথবা সাম্রাজ্যবাদী কানাডার গণ্ডমূর্খ নেতারা জনগণকে এই নিদান দিক, এসি মাথায় নিয়ে হাঁটার।’…
  5. ‘বাংলাদেশের এক বিশাল সংখ্যার তারুণ্যকে অরাজনৈতিক, দায়িত্বহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অবৈজ্ঞানিক, যৌনতাগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, অবসাদগ্রস্ত, উন্নাসিক, আত্মভোলা, নিস্ক্রিয়, ব্যধিগ্রস্ত, কর্মবিমুখ ও প্রতিক্রিয়াশীল করতে হুমাযুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে গত চার দশকে।’…
  6. ‘বইকেনা অপ্রয়োজনীয়, বিশেষ করে যে আবর্জনা লেখা হয়। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বই ছাড়া অন্য বই না থাকলেও পৃথিবীর খুব একটা ক্ষতি হবে না।’…
  7. ‘ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। যারা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে, তাদেরকে আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’…
  8. ‘বাংলা একাডেমি প্রতিক্রিয়াশীল বদমাশ, পাঁজিদের আখড়া হয়ে গেছে। ওরা মাঝে মাঝেই এসব করে। এগুলাকে অন্তত দুই বছর কৃষকের ঘরে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য পাঠানো উচিত।’…
  9. ‘তিনি (বদরুদ্দীন উমর) ২০০০ সালের পরে, মানে ৭০ বছর বয়সে এসেও লেনিনবাদী পার্টি না গড়ে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামক সোনার পাথর বাটি গড়েছিলেন। কোনো যুক্তফ্রন্টের নীতি অনুসরণ করে এটা গড়া হয়নি।’…
  10. ‘আধুনিক বর্বর ব্রিটিশদের গর্ব করার মতো কিছু নেই। একটা পিশাচিনী ছিল। সেও নাই হয়ে গেল।’…
  11. ‘বাংলাদেশের মুক্তমনা, মুক্তচিন্তক আর নাস্তিকরা নীতিবিবর্জিত ভোগবাদী।’…;
  12. ‘জাসদ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী গণবিরোধী দলের নাম’…
  13. ‘অমর্ত্য সেন শৌচাগারের অর্থনীতিবিদ’…
  14. ‘সারেগামা গণশত্রুদের প্রতিষ্ঠান’…
  15. ‘মূর্খতা এখনকার জনপ্রিয়দের অহংকার।’…
  16. ‘মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা স্তালিন’…
  17. ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেসব কারণে জনগণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা বিরোধী’ (নিবন্ধের শিরোনাম) …
  18. ‘প্রকাশক ও সম্পাদকের অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে আমাদের দেশের বাংলা সাহিত্য চর্চাকারী ব্যক্তিগণ লেনিনের জ্ঞানকে প্রয়োজনীয় মনে করেননি’। (সাহিত্য প্রসঙ্গে ভি. আই. লেনিন বইটি নিয়ে)

অনুপ সাদির চিন্তাচেতনার সাথে ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের মতভিন্নতা থাকতেই পারে। তবে তাকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার অধিকারটুকু দিতে হবে। আমরা চাই অনুপ সাদি দ্বান্দ্বিকতায় পঠিত ও আলোচিত হোক, নৈর্ব্যক্তিকভাবে মূল্যায়নে থাকুক। আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা এমন যে, অনুপ সাদির মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা উত্তরোত্তর বাড়ুক, দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আরও প্রসারণ ঘটুক। মার্কসবাদের একনিষ্ঠ কর্মি আমাদের অনুপ সাদি মার্কসীয় জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থতত্ত্ব, পরিবেশতত্ত্ব, সর্বোপরি সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে লিখুক এবং কথাসাহিত্যেও আসুক। 

২১-২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ময়মনসিংহ।

আরো পড়ুন

বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৩৭-৪২, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!