আনোয়ার হোসেন (২২ এপ্রিল ১৯৫৮ – ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) ছিলেন একজন সাম্যবাদী ধারার রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল ধারার কর্মী এবং সমাজসচেতন ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৫৮ সালের ২২ এপ্রিল নেত্রকোনা শহরের মেছুয়া বাজারে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নূর হোসেন এবং মাতা রহিমা খাতুন। তার পিতা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাঁর আদি নিবাস কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীয়া। তিনি এমন এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে স্বল্প বিনিয়োগে ব্যবসা করে রাতারাতি ধনিক শ্রেণীতে পরিণত হওয়া ছিল খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু আজীবন সংগ্রামী আনোয়ার হোসেন সে পথে যাননি।
শ্রমজীবী মানুষের প্রতি কমরেড আনোয়ারের ছিল অসীম দরদ ও ভালবাসা তাই তিনি মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সমাজ বদলের স্বপ্ন নিতান্তই কোন মোহ দ্বারা তাড়িত নয়। তিনি হৃদয় দিয়ে সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নিয়েছিলেন। আনোয়ার হোসেন আঞ্জুমান সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। তাঁর লেখাড়া অর্থাৎ বড় হয়ে উঠার পেছনে পারিবারিক ভাবে সহায়তা করেন বড় বোনের জামাতা অর্থাৎ তাঁর বড় দাতা। ১৯৬৮ সালে নোমানের পরিবার এবং হাবিব স্যারের অনুপ্রেরণায় মতিয়া চৌধুরী নেতৃত্বাধীন রাজনীতির প্রতি আসক্তি এবং হরি শংকর চৌধুরীর প্রেরণায় তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অনিল সাহা, পরেশ সাহা, সমীরণ ছিলেন তাঁর সহপাঠী। তাদের দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।
চেতনার অতন্দ্র প্রহরী আনোয়ার হোসেন চিন্তা করতেন মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে। শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কায়েম করতে হবে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ। তিনি যখন এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বাভাবিক ভাবে অতি সাধারণ পরিবারের সদস্য হিসাবে তার বড় বোন আয়েশা আক্তার এর প্রতিবাদ করবেন, আনোয়ার হোসেনকে নিবারণ করবেন এটাই ছিল তার পরিবারের প্রত্যাশা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে তাঁর বড় বোন আয়েশা আক্তার ও বড় বোন জামাই মৃত আব্দুর মালেক অর্থাৎ বড় দাদা দাড়ালেন আনোয়ার হোসেনের পাশে।
আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে একটি বক্তৃতা শুনুন
স্বাধীন দেশে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রকোনা মহকুমার প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ডাঃ মৃনাল বিশ্বাস, সুকুমার ভাওয়াল, শাহ আব্দুল মোতালিব, সুরুজ মিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। এমন পরিবেশে ১৯৭৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে অর্ন্তভূক্ত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় বিভিন্ন লঙ্গরখানায় কাজ করেন এবং বন্যা উত্তর ধান উৎপাদনে কৃষকদের সহযোগিত করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নেত্রকোণা জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। বিভিন্ন সময় তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন প্রয়াত কুন্তল বিশ্বাস ও আজিজ ভাই (তিতাস গ্যাসের সাবেক এমডি) ।
কমরেড আনোয়ার হোসেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্তের কবিতা আবৃত্তি করতে ভালবাসতেন। তিনি মৃত্যুর আগেও বার বার বলেছেন “মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান”।পরবর্তী পর্যায়ে পার্টির সিদ্ধান্তে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সার্বিক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নেত্রকোনা জেলার প্রথম কমিটির সভাপতি এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রকোনা দশম সম্মেলনে জেলা কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত নেত্রকোনা ট্রেড ইউনিয়নের ৭টি বেসিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন।
আনোয়ার হোসেন শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একবার নেত্রকোণা কাটাখালির এক সাধারণ শ্রমিককে হরগাতির এক প্রভাবশালী ব্যক্তি আটকে রেখেছিলেন। খবর পেয়ে শ্রমিকদের চিরবন্ধু আনোয়ার হোসেন সেই শ্রমিককে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সাধারণ শ্রমিকের মতোই আর্থিক সংকটের মধ্যে সংসার চলত আনোয়ার হোসেনের কিন্তু আমরা তাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়নি।
আরো পড়ুন
- অরবিন্দ সাংমা দিও নেত্রকোণা জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা
- অনাথ নকরেক ছিলেন নেত্রকোণা জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা
- অনিমা সিংহ ছিলেন একজন বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের নেত্রী
- বাদল মজুমদার একজন লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
- আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন সাম্যবাদী ধারার রাজনীতিবিদ
- আবদুল বারী ছিলেন সাম্যবাদী ধারার রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক
- আবু তাহের ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের যুগের বামপন্থী সমাজগণতন্ত্রী বিপ্লবী
১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান এবং ৮০ দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের নৈরাজ্যে নিহত নেত্রকোণার শহীদ তিতাসের লাশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ এবং এর নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। সিপিবি-অফিস এবং রমনা বটমূলে জঙ্গিদের বোমা হামলার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিলেন আজীবন যোদ্ধা আনোয়ার হোসেন। তাছাড়া বিভিন্ন আন্দোলন এবং সংগ্রামে তার সাহসী ভূমিকাকে কখনই খাটো করে দেখা যাবে না। কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করাই ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। টিইউসি ছিল তাঁর সন্তানের মতো । তাহ মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেও এবং মৃত্যুর সাথে রাতেও তিনি টিইউসি এর অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ।
২০০৪ সনে আনোয়ার হোসেন হার্টের রোগে আক্রান্ত হন। কিছুদিন তিনি ঢাকায় চিকিৎসা করার পর পার্টির সহযোগিতায় ভারতের মাদ্রাজে যান উন্নত চিকিৎসার জন্য। রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তিনি বেশ কিছুদিন যাবৎ নেত্রকোণায় নিউটাউনের বাসায় অবস্থান করছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পার্টির সকলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সকাল ১১:৩০ মিনিটে নেত্রকোণা আধুনিক সদর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। তিনি দুই মেয়ে, এক ছেলে, স্ত্রী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যু নেত্রকোণা রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অপূরনীয় ক্ষতি। তিনি শ্রমিক নেতা, সংস্কৃতিমনা, সদালাপী, অমায়িক ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।
রচনাকাল: ২ নভেম্বর ২০২৩, কুরপাড়, নেত্রকোনা
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।