অনিমা সিংহ, অন্য বানানে: অণিমা সিংহ, ছিলেন একজন বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। ১৯২৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অন্নদা প্রসন্ন দাস ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা আশালতা দাস একজন শিক্ষিত গৃহিনী।
সিলেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় অনিমা সিংহ সক্রিয় রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য পারিবারিক বাধাকে অতিক্রম করেছিলেন মায়ের সহযোগিতায়। তার মা একজন প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে নিযুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে অনিমা সিংহ মার্কসবাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শ্রমজীবি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে সামিল করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং তার সংকল্প ও দৃঢ় কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯৪৭ সালের পর বিদ্রোহী হাজং কৃষকরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় বারের মতন জোর আন্দোলন শুরু করেছে। সেই সময়টাতে নানান প্রতিকূলতা ও জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে অনিমা সিংহ কৃষক আন্দোলনের সাথে নিজেকে পুরোপুরি যুক্ত করেন। কৃষকদের সংগঠিত করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জের জনপ্রিয় কৃষকনেতা রবি দাসের সংগে তার বিবাহ হয়। বিয়ের পর তারা দুজন পাহাড়ে চলে যান এবং সশস্ত্র আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তার স্বামী পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
১৯৫০ সালের সেই দুর্বার কৃষক আন্দোলনে অনিমা সিংহও হাজংদের সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতেও একে একে ছড়িয়ে পড়েছে কৃষক আন্দোলনের স্লোগান। কৃষকের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনিমা সিংহ দিনের বেলায় সঙ্গীদের সাথে পাহাড়ী এলাকাগুলোতে আত্মগোপন করে থাকতেন। সন্ধ্যা নেমে এলেই পাহাড়ী ঢাল থেকে নেমে গ্রামে গ্রামে মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে টংক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই অংশগ্রহণ করা জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
১৯৫০ সালেই আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার টংক প্রথা বাতিল করলেও আন্দোলনের সংগঠক নেতা কর্মীদের উপর চলতে থাকে চরম দমন পীড়ন ও অত্যাচার। অনিমা সিংহ এমন পরিস্থিতিতে পার্টির নির্দেশে চলে আসেন সিলেটে। সেখানে কিছুদিন আত্মগোপনের পর পার্টি নির্দেশে অনিমা সিংহ চলে আসেন ঢাকা। সেখানে আত্মগোপন থাকা অবস্থায়ই ১৯৫৫ সালে অনিমা সিংহ ও বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
আত্মগোপন অবস্থায় নানান সমস্যা ও দুরবস্থার মধ্যেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ এবং ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ শতকের পাঁচ ও ছয় দশক এই দুই বিপ্লবী আত্মগোপন অবস্থাতেই কাটান। তাদের একমাত্র সন্তান দিবালোক সিংহ বড় হলে আত্মগোপন অবস্থায় থাকাটা খুবই সমস্যার হয়ে পড়লে তিনি ত্রিপুরায় চলে যান। মুক্তিযুদ্ধেও শুরু থেকেই তিনি আবারো সক্রিয়ভাবে কাজে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শরণার্থী শিবিরের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
আরো পড়ুন
- অরবিন্দ সাংমা দিও নেত্রকোণা জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা
- অনাথ নকরেক ছিলেন নেত্রকোণা জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা
- অনিমা সিংহ ছিলেন একজন বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের নেত্রী
- বাদল মজুমদার একজন লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
- আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন সাম্যবাদী ধারার রাজনীতিবিদ
- আবদুল বারী ছিলেন সাম্যবাদী ধারার রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক
- আবু তাহের ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের যুগের বামপন্থী সমাজগণতন্ত্রী বিপ্লবী
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনিমা সিংহ কৃষক সমিতির সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে মস্কোতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের প্রবল বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় অনিমা সিংহ নিজের বাসায় রুটি বানাতেন এবং সেই রুটি বিতরণ করা হত। ১৯৮০ সালের জুন মাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারাত্নকভাবে আহত হন এবং ২রা জুলাই এই বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, দোলন প্রভা, নেত্রকোণা জেলা চরিতকোষ, টাঙ্গন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, জুন ২০২৪, পৃষ্ঠা ২৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।