কমরেড আলতাব আলী (ইংরেজি: Altab Ali, ১৯০৭-১৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৮০) ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিক ও বহুবিধ শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের নেতা। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশের পর আই, এ, পর্যন্ত পড়েছিলেন। কিশোর বয়সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়তার জন্য উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ সম্ভবপর হয়নি। স্কুলে পড়ার সময় ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। শক্তিশালী বিপ্লবী যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন।
কমরেড মুজফফর আহমদের পিজেন্ট এন্ড ওয়ার্কার্স পাটির সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের সানকি পাড়ায় ফয়েজ দিন হোসেনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে কর্মী হিসাবে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। সে সময় ময়মনসিংহ পৌরসভার হরিজনদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন এবং একই সাথে বিভিন্ন সময় নিঃস্ব শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কিশোরগঞ্জে মে দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ইয়ং কমরেড লীগের সম্মেলনে যোগ দেন। সুদখোর মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
একই সনে ময়মনসিংহ জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীদের অনশনের সময় ব্রিটিশ বিরোধী মিছিলে যোগ দিয়ে প্রথমবারের মত গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পেয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানায় চলে যান। এই সময় তিনি ইংরেজদের র্যালী ব্রাদার্স ভাংচুরে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৩২ সালে ময়মনসিংহের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের ঘোড়ার গাড়ীর গতিরোধ করতে গেলে, পুলিশের গাড়ী আলতাব আলীর শরীরের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়। পুলিশের গাড়ীর নীচে চাপা পড়ে তাঁর এক পা ভেঙ্গে গিয়ে গুরুতর আহত হন। গোপনে চিকিৎসা গ্রহণ করেন, পুলিশ হুলিয়া জারি করে রাখে।
১৯৩৩ সালের দিকে গ্রেপ্তার হন। অন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ৫ বছর কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পান। অনুশীলন দলের ছদ্মবেশী সন্নাসী গ্রুপে যোগ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অনেক প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন আলতাব আলী। এর মধ্যে ১৯৩৮ সালে হায়দারাবাদে এবং ১৯৩৯ সালে শিলিগুড়ির ইংরেজ আস্তানা আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। সাম্যবাদী কৃষক নেতা মণি সিংহের সঙ্গে একসঙ্গে দীর্ঘদিন একই সেলে কাটান। জেলে থাকার সময় সাম্যবাদ সম্পর্কে প্রচুর পড়াশুনা করে জ্ঞানার্জন করেন এবং সাম্যবাদী রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবেশের প্রস্তুতি নেন। মুক্তির পর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিষ্ট পাটির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সাত সদস্যের মধ্যে একজন হিসেবে সদস্য পদ লাভ করেন। সেই কমিটির অন্যান্য ৬ সদস্য ছিলেন পুলিন বকসী, মণি সিংহ, ক্ষিতীশ চক্রবর্তী, রবি নিয়োগী, পবিত্র শঙ্কর রায় ও জেলা সম্পাদক হন খোকা রায়। পরে যুক্ত হয়েছিলেন নগেন সরকার ও সুনির্মল সেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ ও পরবর্তী সময়ে সীমান্তবর্তি গারো পাহাড় ও জেলার পব প্রান্তর্বতী বিভিন্ন জায়গায় গারো-হাজং এবং সাধারণ কৃষকদের সঙ্গে কাজ করেন। টংক ও তেভাগা আন্দোলনে জড়িত হন। জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নালিতাবাড়ীতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম কৃষক নেতা হিসাবে অংশ গ্রহণ করেন। সে সম্মেলনে অন্য তিন জেলা কৃষক নেতা খোকা রায়, মণি সিংহ ও ক্ষিতীশ চক্রবতীও যোগদান করেছিলেন।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোণার নাগরার মাঠে অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক কর্মী হিসাবে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। সম্মেলনে পাঁচ হাজার কর্মী সমন্বিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মেজর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তাঁর নেতৃত্বে নালিতাবাড়িতে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫১ সালে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ লিখা লিফলেট বিতরণ করেন। সে বছরই পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে জয়দেবপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কর্মীদের মাধ্যমে ‘কালো পতাকা’ উত্তোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯৫৪ সালে আবার কারাবরণ করেন। মুক্তিলাভের পর ময়মনসিংহের হরিজনদের অধিকার আদায়ের সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ইতিহাসে যা ‘ধাঙ্গর বিদ্রোহ’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ কাটে কারাগারে। দেশ বিভাগ ও পরবর্তীকালে তিনি সর্বমোট ১২ বছর কারাগারে এবং ২০ বছর আত্মগোপনে কাটান।
দীর্ঘদিন বিভিন্ন পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা শাখার সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কৃষক সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি গঠিত হলে সে দলে যোগদান করে পার্টির জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জেলা ন্যাপের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৬৯ সালে আবারও গ্রেফতার হন তিনি । মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ময়মনসিংহে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি৷ তাঁর স্ত্রী মজিরুন্নেছাও উক্ত কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সনে কমরেড জ্যোতিষ বসুসহ সীমান্ত অতিক্রম করার সময় লেংগুড়া বাজারের নিকট ই,পি,আর এর হাতে আটক হন এবং এক পর্যায়ে উভয়কে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতোমধ্যেই উক্ত সীমান্তবর্তী এলাকায় খবরটি ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনসাধারণ তৎপর হয়ে উঠেন এবং তাঁদেরকে মুক্ত করেন। বিখ্যাত টংক আন্দোলন অধ্যুষিত এই সীমান্ত এলাকার জনসাধারণের কাছে আলতাব আলী ও জ্যোতিষ বসু নামটি ছিল খুবই পরিচিত–সর্বস্তরের জনতার প্রতিরোধের মুখে সেদিন তাঁরা দুজন প্রাণে বেঁচে যান।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসাবে তেজপুর ক্যাম্পের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন কমরেড আলতাব আলী। একাধিকবার ন্যাপের পক্ষ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ও পরে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্যপদ প্রাথী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য জয়লাভে ব্যর্থ হন। এক কথায় তিনি দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের পর রাজনীতি ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণ করেন।
কমরেড আলতাব আলীর জন্ম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ শহরের সেহড়াতে। পিতার নাম ডেংগু বেপারী ও মাতার নাম জিলফত বেওয়া। পিতামাতার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। তিনি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
১. দরজি আবদুল ওয়াহাব, ময়মনসিংহের চরিতাভিধান, ময়মনসিংহ জেলা দ্বিশতবার্ষিকী উদ্যাপন কর্তৃপক্ষ, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ, এপ্রিল ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ১২৭-১২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।