ঈশপ বা ঈসপ বা এসপ (ইংরেজি বানানে: Aesop; আনুমানিক ৬২০–৫৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একজন গ্রীক কল্পকাহিনী এবং গল্পকার ছিলেন, যার লেখা প্রচুর উপকথা এখন সম্মিলিতভাবে ঈশপের গল্পকথা নামে পরিচিত। গ্রীস দেশের বিখ্যাত এই গল্প-কথক ঈশপ চিরকালের গল্পের রাজা অথচ তিনি কখনো কলম ধরে একটিও গল্প লেখেননি— অন্য সব লেখকরা যা করেন। কাজের ফাঁকে পথ চলতে চলতে ক্লান্তি দূর করবার উদ্দেশ্যে তিনি মন থেকে তৈরি করে অবলীলায় গল্প বলে যেতেন।
তাঁর নীতিমূলক গল্পগুলো বুদ্ধিদীপ্ত ঘটনায় ভরা। তিনি জীবজন্তুর মুখে মানুষের মুখের ভাষা ফুটিয়েছেন। তাদের দিয়ে মানুষের দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি কটাক্ষপাত করেছেন। মানুষের নীতিবোধ যাতে জাগরিত হয়, ন্যায় ও অন্যায়, কর্তব্য ও অকর্তব্য মানুষ বিবেচনা করতে পারে; তার উপযুক্ত পথ ঈশপ নির্দেশ করেছেন তাঁর গল্পের মধ্য দিয়ে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তবুও আজও পৃথিবীর দেশে দেশে বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ঈশপের এইসব মজাদার গল্পের সমাদর অম্লান। বর্তমান বিশ্বে নীতিকথামূলক গল্পের প্রধান ধারাটি ঈশপের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে।
দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে ঈশপের গল্পগুলো দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে বিভিন্ন দেশের লোককথায় পড়েছে তার প্রভাব। কখনো বা একাত্ম হয়ে মিশে গেছে তার গল্প। কালে কালে তার নামে প্রচারিত হয়েছে এমন অনেক গল্প আদৌ কোনও দিন তিনি বলেননি।
অফুরন্ত গল্পের ভান্ডারী ঈশপের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। প্রাচীন গ্রীসে প্রথম ইউসিবিয়াসের বর্ণনায় তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
ঈশপ ছিলেন গ্রীস দেশের ফ্রিজিয়া নগরের অধিবাসী। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে ৬২০ থেকে ৫৬৪ অব্দ পর্যন্ত তিনি বর্তমান ছিলেন। গ্রীসের ডেলফি রাজ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৪ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
ঈশপ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ইথিওপ থেকে। এর অর্থ করলে দাঁড়ায় ঘোর কালো, কদাকার ইত্যাদি। ঈশপের চেহারার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় তার গায়ের রঙ ছিল কৃষ্ণ বর্ণ। নাকটা ছিল যারপরনাই থ্যাবড়া। পিঠে ছিল দৃশ্যমান কুঁজ। আর পাগুলোও এমন ছিল যে তিনি নাকি সটান সোজা হয়ে চলতে পারতেন না। এদিক থেকে বলা যায় ঈশপ ছিলেন সার্থকনামা।
গ্রীক দেশের স্যামস দ্বীপের রাজা জেনথাসের রাজপ্রাসাদের ক্রীতদাস রূপে ঈশপের জীবন শুরু হয়েছিল। পরে অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার গুণে দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করে স্যামস দ্বীপেইএক ধনাঢ্য বণিক ইশাদমানের অধীনে কাজ নেন। কিছুদিন পরে ঈশপ ভাগ্যের সন্ধানে স্যামস ত্যাগ করে লিডিয়া রাজ্যের রাজা ক্রোসাসের দরবারে এসে উপস্থিত হন।
স্বভাবসুলভ বুদ্ধিমত্তা কৌতুকপ্রিয়তা এবং অসাধারণ প্রতিভাবলে কিছুদিনের মধ্যেই রাজা ক্রোসাসের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। এখানে তিনি রাজবার্তা বহনের দায়িত্ব লাভ করেন। ক্রোসাসের বিশ্বস্ত দূত হয়ে দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্তে পরিভ্রমণের সুযোগ ঘটল তার। ঈশপ যেখানেই যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন তার অফুরন্ত গল্পের ভান্ডার। তার গল্প ও গল্পের নীতিকথা মানুষকে মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করত।
কর্মসূত্রে একবার ডেলফি রাজ্যে যেতে হয় তাকে। সেকালে ভবিষ্যদ্বক্তা পুরোহিত ও সাধুসন্তদের জন্য ডেলফির প্রসিদ্ধি ছিল। সেই সুবাদে যথেষ্ট জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির বাস ছিল সেখানে।
ঈশপ কিছুদিন এইসব ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা করে হতাশ হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, শুষ্ক জ্ঞানচর্চা করে মানুষগুলো বিবেক ও নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে। আকাশচুম্বী এদের লোভ আর অহংকার। দেশের সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাস ও ভক্তি ভাঙ্গিয়ে এরা অফুরন্ত বিত্ত সম্পদের অধিকারী হচ্ছে।
সৎচিন্তা ও জ্ঞান সাধনার এই পরিণতি ঈশপকে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করে তুলল। তিনি জনসাধারণকে অবিলম্বে এদের সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত মানুষ তার হিতকথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারল না। একদিন ক্রুদ্ধ জনতার হাতে নির্মমভাবে তিনি নিহত হন। কিছুদিন পরেই অবশ্য ডেলাফিবাসীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হল। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে তারা নির্মাণ করল এক সুদৃশ্য পিরামিড।
ঈশপের নীতিকথার গল্পগুলো দীর্ঘদিন মানুষের মুখে মুখেই ফিরেছে। তার মৃত্যুর প্রায় তিনশত বৎসর পরে ডিমিস্ট্রিয়াম ফেলিরিয়াম নামে জনৈক আথেন্সবাসী গল্পগুলো সংগ্রহ করে একত্র গ্রথিত করেন। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে ব্যাব্রিয়াস কতগুলি গল্প পদ্যে রূপ দেন। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে ল্যাটিন ভাষায় গল্পগুলো অনুবাদ করেন ফদেরাস।
এরপর প্রায় দীর্ঘ পাঁচশ বছর মানুষ এই সংকলনগুলোর কথা ভুলেছিল। সহসা অ্যাথোস পর্বতের এক মন্দিরে একটি পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় এবং তারপর থেকেই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বই আকারে ঈশপের গল্প পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ব্রিটেনে ঈশপের গল্প প্রথম অনুবাদ করেন ক্যাকসাস ১৪২৪ খ্রিঃ। ১৬২২ খ্রিঃ ফরাসী ভাষায় প্রকাশ করেন লা ফঁতেন। বাংলা ভাষায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কথামালা নামে প্রথম প্রকাশ করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। পঞ্চতন্ত্র-এর অনেক গল্পের সঙ্গে ঈশপের গল্পের সাদৃশ্য লক্ষ করবার মত। হিতোপদেশ ও জাতক-কাহিনীতেও এরকম কিছু গল্প আছে।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১০০-১০২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।