আবুল কাসেম ফজলুল হক (ইংরেজি: Abul Quasem Fazlul Hoque, জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪) যেসব মানুষের মাঝখানে বেঁচে আছেন সেসব মানুষের জন্যই তিনি ভেবেছেন এবং তাদের জন্যই তিনি কলম ধরেছেন। বার বছর বয়সে তিনি লিখে প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন এবং তা এখনো শরতের ছন্দময় স্নিগ্ধ মৃদু হাওয়ার মতোই অব্যাহত আছে। তিনি লিখেছেন বলেই আমরা তার লেখা পড়েছি এবং তার চিন্তার সাথে পরিচিত হয়েছি।
আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি যে মানুষটি ‘সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যানুরাগ’ নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেন তা আজ সূর্যালোকের পাখায় ভর করে বিকশিত হতে হতে বাংলাদেশের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা এখন স্থির হয়ে দেখতে পারছি যে মানুষটি রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) মতো এই সুন্দর ভূবনে মরিতে না চেয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার অসীম প্রেরণায় কাজ শুরু করেছিলেন তা ধীরে ধীরে দীর্ঘ পাঁচ যুগ ধরে এগিয়ে গেছে আগামীর দিকে। তিনি লিখেছেন বহু বিচিত্র বিষয়ে, জ্ঞানকে বিতরণ করেছেন অজস্র মানুষের মাঝে, কমিউনিস্ট রাজনীতিকে প্রচার করেছেন বাংলা ভাষায় এবং জনমত তৈরি করেছেন পুস্তিকা, মুঠোকাগজ, ভাঁজপত্র ও প্রচারপত্র লিখে।
মানুষ ও তার পরিবেশের রূপান্তর সম্পর্কে
আবুল কাসেম ফজলুল হকের চিন্তার একটি বিশাল অংশজুড়ে আছে সংহতি ও সাম্য আকাঙ্ক্ষী মানুষের স্বরূপ অনুসন্ধান এবং আশপাশের পরিবেশের রূপান্তর সম্পর্কে গবেষণায়। তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী স্তালিনবাদী বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে অবলম্বন করে মানুষ ও তার পরিবেশ সম্পর্কে বাংলাভাষী মানুষকে সচেতন করে তুলেছেন।
মূল নিবন্ধ: মানুষ ও তার পরিবেশ এবং মানুষের স্বরূপ
আবুল কাসেম ফজলুল হকের কাছে মানুষ হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দীর্ঘ সংগ্রাম ও শ্রমের দ্বারা উদ্ভূত এক বিকাশশীল জীব। মানুষকে তিনি পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের মতো এক নিষ্ঠুর আদিম নৃশংস বন্য প্রাণী হিসেবে কখনোই দেখেননি। তার কাছে মানুষ হচ্ছে সামাজিক সংগ্রামী জীবনবাদী বাস্তবের মানুষ।
মানুষকে নিয়ে ভাবতে গিয়েই তিনি ভেবেছেন তার সময়ের আশপাশের মানুষ ও তার পরিবেশকে। মানুষের আত্মপরিচয়, আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস, স্বাজাত্যবোধ নিয়ে চর্চা করে কাটিয়েছেন পাঁচ দশক, যে সময়টিকে তিনি বলেছেন অবক্ষয়ের কাল।
রাষ্ট্রচিন্তায় আবুল কাসেম ফজলুল হক
অধ্যাপক ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদ ও তার পরিপূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং মালেমাবাদ বা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদকে কেন্দ্র করে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের জন্য লড়াই করতে গিয়ে তিনি বিরোধীতা করেছেন পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়নের সংগে যুক্ত সমস্ত প্রতিবিপ্লবী চিন্তাধারাকে।
মূল নিবন্ধ: আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা প্রসঙ্গে
আবুল কাসেম ফজলুল হক যেসব চিন্তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে চান তার প্রথমটিতেই আসে আত্মনির্ভরতা, আত্মশক্তি, স্বাজাত্যবোধ ও দেশপ্রেমের বিকশিত রূপ হিসেবে জাতীয়তাবাদ ও তার পরিপূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। তিনি আত্মনির্ভর শক্তিমান সমৃদ্ধিমান একটি জাতি চান যারা নিজেরা নিজেদেরকে স্বাধীন রাখবে, নিজেদের আত্মবিকাশের পথ নির্মাণ করবে, বাইরের অপশক্তির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করবে।
বাঙালির আত্মপরিচয় ও নবজাগরণ সম্পর্কে
বাঙালির আত্মঅনুসন্ধান ও নবজাগরণ বিষয়টিকে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেখেছেন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতার জায়গা থেকে এক নিপীড়িত জাতির জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিকশিত হবার দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি জাতীয়তাবাদের পরিপূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে অবলম্বন করে মানব জাতির অংশ হিসেবে বাঙালির জাগরণ ও বাংলার জনগণের প্রগতিকে কামনা করেন।
মূল নিবন্ধ: বাঙালির আত্মপরিচয় ও নবজাগরণ
বাঙালির যে রাষ্ট্রটি বাংলাদেশ নাম ধারণ করে টিকে থাকার চেষ্টায় নিয়োজিত সেই রাষ্ট্রটি ও তার মানুষগুলোর কর্মপ্রচেষ্টাকে তিনি বারবার মূল্যায়ন করেন। তার কাছে রাষ্ট্র শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র তার কাছে কেবল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একটি ঐক্যবদ্ধ সুদৃঢ় শক্তিমান সমৃদ্ধিমান মানবজীবনের সারাৎসার; যে জীবন গড়ে তুলেছেন হাজার বছরের চেষ্টায় সেসব মনীষারা যারা নিজেদের বাঙালি বলে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করেছেন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক ও তাঁর ব্যক্তিক মূল্যায়ন
জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ, মার্কসবাদ লেনিনবাদ মাওবাদ, মুক্তি, সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে কাজ করা এই মানুষটি সম্পর্কে বারবার আমার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে এসেছে; তাকে কীভাবে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যায়।
আমার মুঠোফোনে তিনি A q f h sir, মুখে বলি কাসেম স্যার, এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে তাকে আমি সত্যিকারভাবে চিনি। সহজ সরল সদালাপী এই মানুষটিকে শত কথার পুনরাবৃত্তির ভিঁড়ে খুঁজে পেলে মনে হবে তিনি নিরহংকার, প্রাণবন্ত, যুক্তিপরায়ণ, সাহসী, সত্যসন্ধিৎসু, আদর্শিক, জীবনমুখি, পার্থিবতাকেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক, নিঃসঙ্গ পথের পথিক এক আলোকোজ্জ্বল মানুষ।
আমার মনে হয়েছে তিনি মানবতাবাদ, মার্কসবাদ ও জাতীয়তাবাদের এক অপূর্ব সমন্বয়। তিনি স্বপ্ন দেখে চলেছেন বাংলাদেশ একদিন সারা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, নিপীড়িত জাতিগুলোর পক্ষে লড়াই করে এদেশ পৃথিবীকে এগিয়ে নেবে সমতার ভূমিতে, এদেশের মানুষগুলো ঐক্য গড়ে তুলবে সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে, সংগঠিত বিবেকের শক্তিতে পরাজিত করবে আধিপত্যকে। এই মানুষটি আমাদের মাঝে কিংবদন্তিতে পরিণত হননি; কেননা তিনি চটকদার কথা বলে অতি দ্রুত পরিচিতি লাভের চেষ্টা করেননি। তিনি তার কর্মে ধীরস্থির ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন বলে সেই ১৯৮৫ সালে আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) তাকে বাঙলা ভাষায় বিদ্যাচর্চাকারিদের মধ্যে পাঁচজনের একজনরূপে নিয়েছিলেন[১] এবং ধীরে ধীরে তা সকলের সামনেই প্রতিভাত হয়েছে।
বহুবার তাকে আমি দেখেছি, তিনি কোলকাতার সংগীত চ্যানেল তারা মিউজিক-এ পুরোনো দিনের গান শুনছেন। গান শুনতে শুনতেই আবৃত্তি করছেন ‘এ-দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি, অন্তরে নিয়াছি আমি তুলি, এই মহামন্ত্রখানি, চরিতার্থ জীবনের বাণী’, তখন আমার মনে হয়েছে যে জীবন ও পরিবেশকে সংগে নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন তাতে যন্ত্রণার চেয়ে আনন্দের পরিমাণই বেশি। অথচ অন্য কোনো বিষাদগ্রস্ত সময়ে যখন দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করেন ‘নির্যাতনই এখনকার বৈশিষ্ট্য’ তখন তারই বেসুরো কণ্ঠে গাওয়া শ্যামল মিত্রের ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর, হাসি আর গানে ভরে তুলবো’ গানটিকে মিথ্যার ভাস্কর্য মনে হয়।
আমার স্বপ্ন ছিলো একবার সারারাত তার সাথে পুরো ঢাকা ঘুরে ঘুরে দেখবো অন্ধকার আর নিয়ন আলো, অভাব আর প্রাচুর্য কত বিচিত্রভাবে মিলেমিশে আছে এই নগরে। আমার সেই স্বপ্ন আজো পূরণ হয়নি।[২]
তথ্যসূত্র
১. দেখুন, হুমায়ুন আজাদ; সাক্ষাৎকার; আগামী প্রকাশনী; ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪; পৃষ্ঠা ৪৩।
২. লেখাটি প্রাণকাকলি ব্লগে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে লেখাটিকে রোদ্দুরে ডট কমে ১১ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশ করা হয়। ফুলকিবাজ ডট কমে প্রকাশের সময় লেখাটিকে পরিমার্জন করে মোট চারটি প্রবন্ধে প্রকাশ করা হয় ১৪ মে ২০২১, তারিখে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।