আবু তাহের ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের যুগের বামপন্থী সমাজগণতন্ত্রী বিপ্লবী

আবু তাহের বা কর্নেল আবু তাহের বীরোত্তম (ইংরেজি: Abu Taher; ১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ – ২১ জুলাই ১৯৭৬) ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের যুগের বামপন্থী সমাজগণতন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক ও বিপ্লবী সংগঠক। তিনি পাকিস্তান আমলে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, ১৯৭১ সালের গণযুদ্ধে ভারতীয় বিস্তারবাদের সহায়তায় অংশগ্রহণ করেন। আবু তাহের ছিলেন একজন দুঃসাহসী সৈনিক, দেশ প্রেমিক এবং বিপ্লবী সংগঠক। একাত্তরের গণযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তৎকালীন সরকার কর্তৃক ‘বীরোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। 

বাংলাদেশ সময়কালের শুরুর দিকে তিনি সমাজগণতান্ত্রিক সংগঠন জাসদের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ক্যুদেতা বা সামরিক অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রতিবেশী অঞ্চল আসামের বদরপুর স্টেশনে নানার বাসায় আবু তাহেরের জন্ম। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ফতেহাবাদ স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে একই বছর চট্টগ্রামের মিরেরশরাই থানার দগপির হাই স্কুলে অল্পদিন শিক্ষকতা করেন, বিপ্লবী সূর্যসেনের এক ঘনিষ্ট সহযোগী তখন সে কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সংস্পর্শে আবু তাহের বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় প্রবল ভাবে উদ্বুদ্ধ উদ্বুদ্ধ হন।[১]

১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশেববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এমএ প্রথম পর্বে অধ্যয়ন করেন।

কর্মজীবন

১৯৬০ খ্রিস্টাব্দেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর ও শিয়ালকোট সেক্টরে অংশগ্রহণ করেন, যুদ্ধে আহত হয়ে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য পুরস্কৃত হন। পরে প্যারা কমান্ডো দল ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’-এ যোগ দেন।

১৯৬৭ – ৬৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ডাবলমুরিং এলাকায় দ্বিতীয় কম্যান্ডো ব্যাটেলিয়নে কর্মরত অবস্থায় বাঙ্গালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ছাত্র-তরুণদের রাজনৈতিক-সামরিক প্রশিক্ষণ দান করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবিত হন। এ বছর তিনি মেজর পদে উন্নীত হন; এবং বিয়ে করেন; স্ত্রীর নাম লুৎফা তাহের।

১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে তাকে পাকিস্তানের আটক ফোর্টে বদলী করা হয় ও স্পেশাল কমান্ডো গ্রুপের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘মেরিন প্যারাসুট উইং’ পান ও উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণর জন্য আমেরিকা যান। জর্জিয়ার ফোর্ট বেনিং-এর রেঞ্জার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ‘রেঞ্জার’ পদকে ভূষিত হন। একই বছর তিনি নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রাগের স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি আটক ফোর্টে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিরোধকল্পে গণযুদ্ধ শুরু করে। ৩০ মার্চ কোয়েটা ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে তাহেরের সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্স অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ করে দেয়া হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল থেকে তাঁকে নজরবন্দি করা হয়। ৭ এপ্রিল কোয়েটা থেকে খারিয়া যাবার পথে পাকিস্তানী বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৮ থেকে ২৮ এপ্রিলের মধ্যে তিনি ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারিকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে তাকে খারিয়া থেকে এবোটাবাদ বেলুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি করা হয়। ২৯ এপ্রিল আবারো পালানোর চেষ্টা করেন ও মীরপুর শহর থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হন। অবশেষে ২৫ জুলাই মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারি এবং মঞ্জুরের পরিবার সদস্যদের নিয়ে ভারতীয় সিমান্ত ঘাঁটি দেবীগড় পৌঁছান। দেবীগড় থেকে ২৭ জুলাই তিনি দিল্লী পৌঁছান। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দিল্লী থেকে মেহেরপুর পৌঁছান।

সেনাপ্রধান এমএজি ওসমানী কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাঁর মতামত প্রদান করেন। ১১ নম্বর সেক্টর গঠন করে তাঁকে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টর অসংখ্য যুদ্ধ পরিচালনা করে; তাহের ঐতিহাসিক কামালপুর অভিযান ও চিলমারী রেইড পরিচালনা করেন। ১৪ নভেম্বর নিজ জন্মদিনে ধানুয়া কামালপুর শত্রু ঘাটিতে বিজয়সূচক আক্রমণ পরিচালনার সময় গুরুতর আহত হন এবং হাটুর উপর থেকে বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়।

পুনা আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টার তথা হাসপাতাল থেকে পর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের পদ পান; পরে জুন মাসে তাকে কুমিল্লায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে বদলী করা হয়।

তিনি প্রচলিত ব্যারাক আর্মির স্থলে উৎপাদনশীল ‘পিপলস আমি’ বা গণ-বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। একই সনের অক্টোবর মাসে স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণী প্রশ্নে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে মত পার্থক্য হওয়ার জন্য তাঁকে প্রত্যক্ষ কমান্ড থেকে সরিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে আর্থিক লাভজনক ডিফেন্স পারচেজের ডিরেক্টর জেনারেল পদে পদোন্নীত করা হয়। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন।

১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ড্রেজার সংস্থার পরিচালক নিযুক্ত হন। 

রাজনৈতিক জীবনে আবু তাহের

তৎকালীন মুৎসুদ্দি সরকারের সাথে বিরোধের জেরে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তৎকালীন মুৎসুদ্দি প্রধান মুজিবর রহমানকে দেয়া পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন যে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকার সময় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হয়েছিল; কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি; পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন যে তিনি জনগণের কাছেই ফেরত যেতে চান ।

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে কর্নেল তাহের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে প্রত্যক্ষ যুক্ত করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের অন্যতম নেতা হিসাবে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে গণবাহিনী গঠন করেন।

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বরের ক্যু’র মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সংঘাতের বিপরীতে অবস্থান নেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহী গণ অভ্যুত্থানকে সংগঠিত করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে, বিপ্লবী গণবাহিনীর সহায়তায় ও জাসদের সমর্থনে শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক জনতার গণতান্ত্রিক অধিকার ও শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষে সিপাহী জনতার অভ্যুথানে নেতৃত্ব দেন। এই অভ্যুত্থানে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও জাসদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে তাঁর কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

আরো পড়ুন

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেবর তৎকালীন ক্ষমতাসীন সন্ত্রাসবাদী মার্কিনপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী মুৎসুদ্দি জিয়াউর রহমান তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও অভ্যুত্থানকারীগণ সহ তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন জেলখানায় এক গোপন বিচার শুরু করে। ১৭ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির হুকুম হয়। ক্ষমতাসীন নরপিশাচেরা ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই তাঁর ফাঁসির হকুম কার্যকর করে। নিজ গ্রামের গোরস্থানে সমাহিত হন। 

আবু তাহের মূল্যায়ন সমস্যা

আবু তাহের আমলাতন্ত্রকে পছন্দ না করলেও আমলাতন্ত্রবিরোধী ছিলেন এমন বলা কঠিন। এই দিক থেকে কর্নেল তাহের ছিলেন লেনিনবাদবিরোধী। এই জায়গা থেকেই এসেছে, তার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহকে আঘাত না করার নীতি। উনি মার্কসবাদের মৌলিক বেশ কিছু বিষয় বুঝতেন না। ফলে বুর্জোয়া নৈতিকতায় আচ্ছন্ন ছিলেন, রাষ্ট্রীয় চেইন অব কমান্ড ও আইন মানতেন। সংবিধান মানতেন।

মার্কসবাদের বিপ্লবী নীতি হচ্ছে ক্ষমতা গ্রহণ। আবু তাহের অভ্যুত্থান শুরু করলেও সংবিধান ও আইনের অনুসারী থেকে গেছিলেন, ফলে নিজেই সেনাবাহিনী প্রধান হওয়া, বা ন্যুনতম গণবাহিনীর প্রধান হওয়া, সেনাবাহিনীকে গণবাহিনীর অধীন করার বিপ্লবী চিন্তা তাঁর মাথায় খেলেনি। আবার উনি রেডিও, টিভি, বিমানবন্দর, বংগভবন, গণভবন দখল করলেও ৭ নভেম্বরের আগের রাতে জেলখানা দখল করার কথা ভাবেননি, ফলে পরবর্তীতে জাসদের নেতাদেরকে মুক্ত করার জন্য ধর্না দিতে হয়েছে গণতন্ত্রের সংহারক জিয়ার কাছে।

মোট কথা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব থাকায়, বিপ্লবকে সফল কীভাবে করতে হয়, সেই জ্ঞান না থাকায়, এমনকি ক্ষমতা দখল বলতে কী কী প্রতিষ্ঠান দখল করতে হয়, সেসব বোধ না থাকায়; যা হবার তাই হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে লরেন্স লিফশুলৎজের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। লিফশুলৎজ বলছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাহের ছিলেন

“এমন একজন যিনি শ্রেষ্ঠ মানবীয় গুণাবলীর এক মূর্ত প্রতীক। যতদূর জানি, উনিশশো ছিয়াত্তরের সেই শান্ত অন্ধকার সকালে তাহের যেভাবে মৃত্যুর সামনে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন সেভাবে তাঁর চেয়ে বেশি সম্মান ও সৌকর্য নিয়ে খুব কম জনই মরতে পেরেছেন। আপন অঙ্গীকারে তাহেরর যতটুকু আস্থা ছিল খুব কম লোকেরই তা থাকে।

অকর্মণ্য, কাপুরুষ, দুর্নীতিবাজ ও বাকসর্বস্ব একদল মানুষের ভীড়ে সহসাই একদিন গড়ে উঠলেন একজন অনমনীয় সৎ ব্যক্তি, আপন অঙ্গীকারে বিশ্বস্ত এক সাহসী পুরুষ। তিনি এক নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে সমাজে তাঁর দেশের কোটি দেশবাসী নিরন্তর অনাহারে ভুগবে না, যে সমাজে তারা সমাজিক বঞ্চণার শিকার হবে না। এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েই তিনি তার নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলেন।”[২]

সাম্রাজ্যবাদের যুগে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সামরিক-বেসামরিক জ্ঞান ব্যতীত যে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়, কর্নেল তাহের জীবন দিয়ে তা প্রমাণ রেখে গেছেন। কর্নেল তাহের অমর রহে।

তথ্যসূত্র

১. দরজি আবদুল ওয়াহাব, ময়মনসিংহের চরিতাভিধান, ময়মনসিংহ জেলা দ্বিশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন কর্তৃপক্ষ, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ, এপ্রিল ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ১০২-১০৪।
২. লরেন্স লিফশুলৎজ, তাহেরের শেষ কথা: অসমাপ্ত বিপ্লব, রুদ্র সাইফুল ও চিন্ময় দাস সম্পাদিত, ক্ষুদিরাম থেকে কর্নেল তাহের, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১ম সংস্করণ ২০১৪, পৃষ্ঠা ১০৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!